আগুন, পিকনিকের হুঙ্কারে বনছুট চিতাবাঘ
শোওয়ার ঘর বলতে টিলা-পাথরের আড়ালে ফুট কয়েকের গুহা। চেনা ড্রইং-রুম, জঙ্গল সীমান্তে ঝোপঝাড় কিংবা চেপ্টি ঘাসের অনন্ত প্রান্তর। আর সান্ধ্য ভ্রমণের পরিসর বলতে বনের প্রান্ত ঘেঁষা বিস্তীর্ণ চা-বাগান।
‘গার্হস্থ্য’ এই ঘেরাটোপ উজিয়ে, দিনে দুপুরেও এখন লোকালয়ে চলে আসছে চিতাবাঘ। শুধুই চা-বাগানের কুলি লাইন নয়, তাদের পা পড়ছে শিলিগুড়ির মতো শহরেও।
বন দফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, গত পাঁচ মাসে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং বা তার লাগোয়া জনপদে অন্তত ২৪ বার দেখা গিয়েছে চিতাবাঘ। সম্প্রতি দার্জিলিঙের টুংসুং এলাকায় তার থাবায় প্রাণ গিয়েছে এক বাসিন্দারও।
নিজের চেনা পরিধি ছেড়ে জনবসতে বার বার কেন ঢুকে পড়ছে চিতাবাঘ? প্রশ্নটা নিয়ে আদৌ উদ্বিগ্ন নন বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন। নির্বিকার গলায় তিনি বলেন, “চিতাবাঘ বের হলে কী-ই বা করার আছে!”
সত্যিই কি কিছু করার নেই? চিতাবাঘ বিশেষজ্ঞ কমলেশ সাংখালা বলছেন, “আলবত আছে। লোকালয়ে চিতাবাঘের ঘন ঘন আনাগোনা রুখতে ঠিক কী করণীয় তা বুঝতেই তো আমরা এখানে এসেছি।” কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের একটি প্রকল্পের প্রতিনিধি হয়ে গত দু-বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চিতাবাঘের স্বভাব-চরিত্রের তত্ত্ব-তালাশ করছেন কমলেশ ও তাঁর দুই সঙ্গী। মাস চারেক ধরে তাঁদের কর্মক্ষেত্র ওড়িশা এবং উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বনাঞ্চল। ওই বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় অস্বস্তি বেড়েছে বনকর্তাদের মধ্যে। উত্তরবঙ্গের এক মুখ্য বনপালের কথায়, “এটা চিতাবাঘের প্রজননের সময় নয়। তা-ও কেন বারবার ওরা লোকালয়ে চলে আসছে তা সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়।”
চিতাবাঘ ঘন বনের বাসিন্দা নয়। বনতলি বা ‘ফ্রিঞ্জ’ এলাকাই চিতাবাঘের পছন্দের ঠিকানা। সেখানে ঘন ঝোপঝাড় কিংবা ঘাস জঙ্গলেই বছরের সিংহভাগ কাটায় তারা। স্বল্প মেয়াদি শীতকালে সেই ঘাস-জঙ্গল শুকনো পাতা আর আগাছার স্তূপে জতুগৃহ হয়ে থাকে।
বন দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন “উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে ঝরা পাতার স্তূপ এখন দাবানল হয়ে ওঠার আপেক্ষায়।” ব্যাখ্যাটা এই রকম, শীতকালে জঙ্গলে জলের সমস্যা নতুন নয়। যা নতুন তা হল, শুকনো পাতা আর আগাছার স্তূপকে বনের প্রতিটি ‘কম্পার্টমেন্ট’-এ জড়ো করে রেখে ‘ফায়ার লাইন’ তৈরির কাজটাই এ বার করা যায়নি। গত দু’মাসে তাই সেবকের দশ মাইল, গরুমারার লাগোয়া কোদালবস্তি এবং নীল পাড়া, মহানন্দা অভয়ারণ্য ও বৈকুণ্ঠপুর অভয়ারণ্য ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে।
ওই সব এলাকায় অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তাই ঘর-বসত খুইয়েছে চিতাবাঘও। কমলেশ বলছেন, “যে সব এলাকায় চিতাবাঘের আনাগোনা বেড়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন সেখানে লাগোয়া ঘাস-বন আগুনে ঝলসে গিয়েছে।” তিনি জানান, কিছু দিন আগে মুম্বইয়ের কাছে সঞ্জয় গাঁধী পার্ক থেকেও একই কারণে লোকালয়ে চিতাবাঘের হানা বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামে তারা হানা দিলে বার বার তলব করেও বনকর্মীদের দেখা নেই। তাই চিতাবাঘের মোকাবিলায় নতুন এক দাওয়াই ‘আবিষ্কার’ করে ফেলেছেন গ্রামবাসীরা।
কমলেশ বলেন, “অনেক সময়েই বাগান-শ্রমিক কিংবা গ্রামবাসীরা ছাগল-কুকুর মেরে তার মধ্যে বিষ মিশিয়ে রাখছেন।” গত পাঁচ মাসে বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছে অন্তত ৬টি চিতাবাঘ।
সমীক্ষায় উঠে আসছে আরও এক নব্য উপদ্রব, পিকনিকের হট্টগোলের কথাও। মহানন্দা, বৈকণ্ঠপুর, কালিম্পংরে সামসিং, সাংলা এলাকায় ঘুরে কমলেশের দাবি, “বহু জায়গায় বনের অন্তত দেড় কিলোমিটার ভিতরেও রীতিমতো সাউন্ড বক্স বাজিয়ে, রান্না-বান্না করে চড়ুইভাতির ভিড় দেখা গিয়েছে এই শীতে।” উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনগুলির পরিচিত মুখ সন্দীপ সরকার বলছেন, “গত কয়েক মাসে পিকনিক পার্টির দৌরাত্ম্যে একেবারে ছারখার হয়ে গিয়েছে জঙ্গলের শান্তি।” দিনে দুপুরেই তাই বন-ছুট হচ্ছে চিতাবাঘেরা। বন দফতরের বন দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “বাধা দেবে কে? বন-পাহারা দেওয়ার লোকই নেই।”
কেন? সংক্ষিপ্ত উত্তর, অর্থাভাব। বন দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন “১৩০ টাকা রোজে এ কাজ এত দিন করতেন বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরাই। এ বার তাদের কাজই দেওয়া যায়নি। একই কারণে তৈরি করা যায়নি ‘ফায়ার লাইন’। নিয়োগ করা যায়নি ‘ফায়ার ওয়াচার’ কিংবা বনে গবাদি পশু ও বহিরাগত প্রবেশ রুখতে বন প্রহরী।”
তা হলে উপায়? বনমন্ত্রী নিরুত্তাপ। তাই হাত-পা গুটিয়ে কি বসে থাকবে বনদফতরও?
সম্প্রতি, শিলিগুড়ির লাগোয়া সুকনার সেনা ছাউনি এবং জংলিকোঠা এলাকায় এক বনকর্মীর বাড়ি থেকে দিনে দুপুরেই গবাদি পশু তুলে নিয়ে যাওয়ার সাহসও দেখিয়েছে চিতাবাঘ। বনকর্মীদের কটাক্ষ, “এ বার আমাদের কবে তুলে নিয়ে যায়, সে অপেক্ষাতেই রয়েছি!”

হানা বৃত্তান্ত
(গত ৫ মাসের পরিসংখ্যান)
এলাকা হামলা
• লাটাগুড়ি
• দার্জিলিং
• শিলিগুড়ি
• বীরপাড়া
• দলগা
• বানারহাট
• গরুমারা
• চিলাপাত
• সুকনা
জঙ্গলে আগুন

• দশমাইল • কোদালবস্তি
• নীলপাড়া • মহানন্দা
• অভয়ারণ্য • বৈকুণ্ঠপুর


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.