নিজেদের হাতে থাকা মামলার ব্যাপারে সিআইডি’র অপ্রস্তুত অবস্থাটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গুড়াপ-কাণ্ড।
গুড়াপ-তদন্তে সিআইডি’র বদলে সিবিআইকে চেয়ে দাখিল হওয়া জনস্বার্থ-মামলার শুনানি ছিল সোমবার, হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। কথা ছিল, সিআইডি তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট পেশ করবে। সিআইডি-কর্তারা এ-ও জানতেন, ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে হাইকোর্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তা-ও সিআইডি মামলা নিয়ে হেলাফেলা করেছে বলে অভিযোগ। যার দরুণ সিআইডি’র প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে আদালত গুড়াপ-কাণ্ডের তদন্তভার তুলে দেয়ে সিবিআইয়ের হাতে। কী রকম হেলাফেলা?
সিআইডি সূত্রের খবর: গুড়াপ-মামলার মূল তদন্তকারী অফিসার সর্বভারতীয় পুলিশ সম্মেলনে ভোপাল গিয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় হাইকোর্টে মামলা দেখভালের ভার পড়েছিল যে ডিএসপি পদমযার্দার অফিসারের উপরে, এ দিন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার ডিউটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমতলায়। হাইকোর্টে পাঠানো হয় অন্য এক ডিএসপি-কে, যিনি মামলাটি সম্পর্কে কার্যত কিছুই জানেন না! তাঁর অনভিজ্ঞতার উদাহরণ এ দিন বার বারই মিলেছে। এমনকী, মামলার ‘কন্ট্রোলিং অফিসার’ও এ ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন বলে সিআইডি সদর ভবানী ভবন সূত্রের খবর। প্রসঙ্গত, এ দিন অন্য মামলার কাজে হাইকোর্টেই ছিলেন। প্রধান বিচারপতির এজলাসে সিআইডি নাকানিচোবানি খাচ্ছে শুনে চলে আসেন। |
তা সত্ত্বেও বিচারপতিদের ভর্ৎসনা থেকে সিআইডি’কে রক্ষা করা যায়নি। তদন্তকারী অফিসারকে এজলাসে না-দেখে সিআইডি-র ‘দায়িত্ববোধ’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে হাইকোর্ট। শেষমেষ গুড়াপ-তদন্তভার সিআইডি-র হাত থেকে নিয়ে সিবিআই-কে সঁপা হয়। কিন্তু মামলার তারিখ আগাম জানা সত্ত্বেও সিআইডি তৈরি থাকল না কেন?
সিআইডি-সূত্রের খবর: তদন্তকারী অফিসার আদৌ জানতেনই না যে, এ দিন হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি আছে। শীর্ষ কর্তাদের অনুমতি নিয়ে তিনি ‘পুলিশ মিট’-এ যোগ দিতে ভোপাল চলে গিয়েছিলেন। সোমবার অবশ্য তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। এসে শোনেন, হাইকোর্ট তদন্তভার দিয়েছে সিবিআইকে। এর প্রেক্ষিতে সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে তদন্তকারীদের সমন্বয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিআইডি-সূত্রের অভিযোগ, আগেও গুড়াপ-কাণ্ডের বিভিন্ন শুনানির তারিখ তদন্তকারী অফিসারকে জানানো হয়নি। এমনকী, গুড়াপ কাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্তের জামিন হওয়ার পরে গোয়েন্দারা সে খবর পান! পাশাপাশি সিআইডি-র তদন্তকারীদের বক্তব্য: গুড়িয়া বাদে যে দুই মহিলার দেহ উদ্ধার হয়েছিল, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট মোতাবেক তাঁদের মৃত্যু স্বাভাবিক। কাজেই তা নিয়ে নতুন মামলা রুজু হয়নি।
হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশের পরেই স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে ভবানী ভবনে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু হয়। ভবানী ভবনে সিআইডি-কর্তারা তদন্তকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তভার কলকাতা গোয়েন্দা-পুলিশের হাত থেকে নিয়ে তুলে দিয়েছেন সিআইডি-র হাতে। ফলে সেটি ‘হিমঘরে’ পাঠিয়ে দেওয়া হল কি না, পুলিশ মহলে ইতিমধ্যে সে প্রশ্ন উঠে পড়েছে। এমতাবস্থায় সিআইডি-র ভাবমূর্তি যাতে সংশয়ের মুখে না-পড়ে, সে বিষয়ে ভবানী ভবনকে প্রশাসনের তরফে যথোচিত ভাবে সতর্কও করে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এ দিন দেখা গেল, সিআইডি রয়েছে সেই সিআইডি-তেই। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, হাইকোর্ট এ দিন যে ভাষায় সিআইডি-কে ভর্ৎসনা করেছে, তাতে অস্বস্তিতে পড়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনিই গুড়াপ-কাণ্ড, প্রদীপ তা হত্যা এবং সর্বশেষ গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তভার সিআইডি-কে অর্পণ করেছেন।
তবে নিজেদের অপারগতার অন্য ব্যাখ্যাও শোনা যাচ্ছে সিআইডি অফিসারদের অনেকের মুখে। এক অফিসারের কথায়, “আমাদের যা পরিকাঠামো, তাতে চেপে বসা মামলার বোঝায় এমনিতেই মাথা তোলার উপায় নেই। তার উপরে নিত্য নতুন তদন্তের ভার আসছে।”
বস্তুত এই পরিস্থিতিতে গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর, বহুশ্রুত, বিতর্কিত ও রাজনীতির রং মাখা একটি মামলার তদন্তভার সিআইডি-র কাঁধে ফেলার যৌক্তিকতা সম্পর্কেও অফিসারদের একাংশের মনে প্রশ্ন জেগেছে। “এমন নয় যে, কলকাতা পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে বলে আদালতের নির্দেশে তদন্তভার পেয়েছি। আবার এমনও নয় যে, মামলায় কলকাতা পুলিশের কেউ অভিযুক্ত বলে নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে সিআইডি-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কাজটা কলকাতা পুলিশই ভাল পারত, সেটা আমাদের ঘাড়ে এনে ফেলা হল কেন?” মন্তব্য এক কর্তার। এবং এই সময়েই গুড়াপ নিয়ে হাইকোর্টের রায় তাঁদের যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলে দিল বলে একান্তে কবুল করছেন ওঁরা। |