সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে লাল কালো ডোরাকাটা জামা পরা ছেলেটির সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দৌড়চ্ছিল যুবকটি। ভিড়ের মাঝে থাকা এক পুলিশ অফিসার ধরেও ফেললেন তাকে। কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না।
কেন? পুলিশ সূত্রের খবর, হাতের আগ্নেয়াস্ত্রটি ওই অফিসারের পেটে ঠেকিয়ে ওই যুবক হমকি দিয়েছিল, “তুমকো ভি গোলি মার দেঙ্গে।” সহকর্মী তাপস চৌধুরীর পরিণতি দেখে হকচকিয়ে যান ওই অফিসার। শিথিল হয়ে যায় তাঁর হাতের বাঁধন। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ওই দুষ্কৃতী।
দুষ্কৃতীর নাম মহম্মদ ইবনে
সাউদ। স্থান গার্ডেনরিচ। সময়, ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর।
ঘটনার পরে পরেই যে-অফিসার ইবনেকে ধরে ফেলেছিলেন, তিনি মিলনকুমার দাম, র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ)-এর ইনস্পেক্টর। এই মিলনবাবুই গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের প্রথম অভিযোগকারী। তাঁরই লেখা এফআইআর কলকাতা পুলিশ গত সপ্তাহে আদালতে জমা দিয়েছিল।
১২ ফেব্রুয়ারি রাতেই পুলিশ অবশ্য ইবনেকে গ্রেফতার করে। তিনি আবার তৃণমূলের শাখা সম্পাদকও। গ্রেফতার হয় লাল কালো ডোরাকাটা জামা পরা তার ভাইপো সেখ সুহানও। এই সুহানের ছোড়া গুলিতেই মৃত্যু হয় তাপস চৌধুরীর। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তৃণমূল কাউন্সিলর তথা ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার নির্দেশেই সুহানকে ওই দিন হরিমোহন ঘোষ কলেজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল ইবনে। ইবনে ও তার সঙ্গীদের সবার হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলেও জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারেরা।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিচুতলার পুলিশ কর্মীরা জানাচ্ছেন, তাপস চৌধুরীর মতো মিলনবাবুও ওই এলাকায় নতুন। এসেছিলেন অন্য শাখা থেকে। তাই ইবনেকে তিনি চিনতে পারেননি। চিনতে পারলে এলাকায় অতি পরিচিত ওই দুষ্কৃতীকে তিনি কখনওই ধরতে যেতেন না। এলাকার দুষ্কৃতীদের না চেনার খেসারত দিতে হয়েছিল তাপসবাবুকে। মুন্নার পরিকল্পনা বুঝতে না পেরে তিনি তাহির হোসেন নামে এক যুবককে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। |
পুলিশ সূত্রের খবর, ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার
রঞ্জিতকুমার পচনন্দা যখন গার্ডেনরিচ থানায় যান, সেই সময়ে মিলনকুমার দামের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। পচনন্দাকেও মিলনকুমার দাম ইবনেকে ধরা এবং ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। পচনন্দা থানায় বসেই জানতে চেয়েছিলেন, কী পরিস্থিতিতে ইবনের মতো অন্যতম প্রধান অভিযুক্তকে হাতে পেয়েও পুলিশ ছেড়ে দিল? পচনন্দা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবেন বলেও তখন জানিয়েছিলেন।
ইবনে এবং সেখ সুহানকে চটপট ধরে নিলেও পুলিশ কেন মুন্নাকে এত দিনেও ধরতে পারছে না, তা নিয়ে পুলিসের নিচুতলাতেই এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, তাঁদের যদি ঘটনার পরই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হত, তা হলে মুন্না-ও এতক্ষণে পুলিশের হেফাজতেই থাকতেন।
ওই সূত্রটি আরও বলেন, মুন্না কোথায় রয়েছেন, তা বুধবার রাতে তাঁরা জেনেও যান। কিন্তু হঠাৎ করে তদন্তভার সিআইডি-র হাতে চলে যাওয়ায় কলকাতা গোয়েন্দা
পুলিশের অফিসারেরা তদন্তের কাজ মাঝপথেই থামিয়ে দেন। সেই সুযোগটাই নেন মুন্না। তা ছাড়া, মুন্না না মোক্তার, আগে কাকে গ্রেফতার করা হবে, তা নিয়েও প্রথম থেকেই
দ্বিধায় ছিলেন অভিযানে থাকা অফিসারেরা। সেটাও মুন্নাকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
সিআইডি-র স্পেশাল আইজি বিনীত গোয়েল অবশ্য সোমবার বলেন, “কোনওটাই অগ্রাধিকার নয়। আমরা মুন্না-মোক্তার দু’জনকেই ধরার চেষ্টা করছি।” কিন্তু বাস্তব চিত্রটা হল, বৃহস্পতিবার কলকাতা পুলিশ যে অবস্থায় তদন্ত সিআইডি-র হাতে ছেড়ে দিয়েছিল, গত চার দিনে তদন্ত ঠিক সেখানেই রয়েছে! এতটুকুও এগোয়নি! সিআইডি-র কতার্রা অবশ্য এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, সোমবার দুপুরেই তাঁদের একটি দল পটনা পৌঁছেছে। তাঁরা মুন্নার এক শাগরেদের আত্মীয়ের বাড়িতে তল্লাশি চালাবেন।
সিআইডি-র দাবি, রবিবার রাতে তাদের একটি দল গার্ডেনরিচের ফতেপুর ভিলেজ রোডের একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির মধ্যে রাখা বালির বস্তার মধ্যে থেকে একটি পাইপগান, এক রাউন্ড কার্তুজ ও ২০টি তাজা বোমা উদ্ধার করে। ওই বাড়ির নির্মাণকাজের সঙ্গে প্রোমোটার হিসেবে যুক্ত আছেন বরো চেয়ারম্যান মুন্না। উদ্ধার হওয়া ওই বন্দুকটি দিয়ে পুলিশ অফিসারকে হত্যা করা হয়নি বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত। মুন্নার সঙ্গী ধৃত চুড়ি ফিরোজই সিআইডি-কে ওই বন্দুক ও বোমা উদ্ধারে সাহায্য করে।
সিআইডি গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তে খুব একটা এগোতে না পারলেও ইবনে ধরে পড়ে যাওয়ায় গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকার মানুষ অনেকটাই নিশ্চিন্ত বলে স্থানীয় পুলিশ অফিসারেরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বাতিকল এলাকার বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের ইবনে মুন্নার এক রকম ডান হাত বলেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে জেনেছেন, হরিমোহন কলেজের
কাছে দুষ্কৃতীরা সে দিন মোট সাত রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল এবং তার মধ্যে অন্তত এক রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল ইবনে নিজে। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ইবনে ও সুহান ছাড়া অন্তত আরও এক জন সে দিন আগ্নেয়াস্ত্র বহন করছিল। তার পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।
গত ৮ জানুয়ারি ডিসি (বন্দর)-এর তৈরি করা পুলিশের একটি বিশেষ দল যখন গার্ডেনরিচ এলাকায় বেআইনি নির্মাণের ছবি তুলছিলেন, সেই সময়ে মুন্নার লোকজন তাঁদের ঘিরে ধরে বলপূর্বক ১৫ নম্বর বরো অফিসে, মুন্নার ঘরে নিয়ে যায় এবং পুলিশকর্মীদের হেনস্থা করে। ওই ঘটনায় ইবনেই নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
|