শ্রমিক সংগঠনগুলির আন্দোলনের জেরে গত ১৯ জানুয়ারি থেকে বসিরহাটের ঘোজাডাঙা স্থল বন্দর দিয়ে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বনগাঁয় পেট্রোপাল বন্দরে স্বাভাবিক ভাবেই চাপ বেড়ে গিয়েছিল। টানা ১৭ দিন বন্ধ থাকার পরে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে ফের বাণিজ্য চালু হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। পরিকাঠামোর নানা সমস্যায় জর্জরিত পেট্রাপোলে বন্দরে চাপ কমায় যখন স্বস্তি ফিরছে প্রশাসনে ঠিক তখনই সাতদিনের মাথায় ১৩ ফেব্রুয়ারি ফের ঘোজাডাঙায় বহির্বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছে জেলা প্রশাসনের।
ঘোজাডাঙায় সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় পেট্রাপোল বন্দরে যে চাপ বাড়ে পরিকাঠামোগত ত্রুটির কারণেই তা বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। পেট্রাপোল বন্দরে যে সেন্ট্রাল ওয়্যার হাউস কর্পোরেশন (সিডব্লুসি)-এর যে ট্রাক টার্মিনাস রয়েছে, সেখানে সব ট্রাক দাঁড়ানোর মতো সুবিধা নেই। ফলে বন্দরমুখী পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলি যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক ও বনগাঁ-চাকদহ রাজ্য সড়কের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকছে। ফলে যা চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকী যে কোনও সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় যানচালক থেকে স্থানীয় মানুষ সকলেই। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের বিশ্বজিৎ দাসও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, “বনগাঁ-চাকদহ সড়কের দু’ধারে যে ভাবে পণ্যবোঝাই ট্রাকের সারি তাতে যে কোনও সময় বড় অঘটন ঘটতে পারে। রাস্তা থেকে ওই সব ট্রাক সরানোর ব্যপাারে এসডিপিও-র সঙ্গে কথা বলেছি।”
পেট্রাপোল শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে মূলত ফল, পেঁয়াজ ও অন্ধ্রপ্রদেশের সাদা মাছ বাংলাদেশে রফতানি হয়ে থাকে। ওই সব পণ্য ‘পচনশীল’ পণ্য হিসাবে পরিচিত। যা এখন পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে ওপারে বেনাপোলে যাচ্ছে। এর ফলে অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।
পেট্রাপোল শুল্ক দফতরের সহকারী কমিশনার শুভেন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘পচনশীল পণ্য হিসাবে পরিচিত ফল, পেঁয়াজ, মাছ এই বন্দরে এলে সেই সব ট্রাক গুরুত্ব দিয়ে আগে বেনাপোলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ফলে বন্দরে আসা অন্য সব পণ্যবোঝাই ট্রাকের বেনাপোলে ঢুকতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।” শুল্ক দফতর সূত্রে খবর, সিডব্লুসি-র ট্রাক টার্মিনাসে পণ্য রফতানির জন্য ৭৫০টি এবং পণ্য আমদানির জন্য ১৫০টি ট্রাক দাঁড়ানোর মতো পরিকাঠামো রয়েছে। এখন বাড়তি ট্রাকের চাপ বাড়ায় সব ট্রাক সেখানে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে টার্মিনাসের বাইরে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকছে। স্থানীয় নরহরিপুর এলাকা থেকে বন্দর পর্যন্ত যশোহর রোডের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এই অংশে রাস্তা দুই লেনের। একটি লেনে এখন পণ্যবাহী ট্রাক দাঁড় করানো রয়েছে, যা অন্য সময় দেখা যায় না। বনগাঁ থেকে গোপালনগর পর্যন্ত বনগাঁ-চাকদহ সড়কের দু’ধারে ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়েছে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। সড়কটি এমনিতেই দুর্ঘটনাপ্রবণ। এখন দু’পাশে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় অবস্থা আরও করুণ। যা থেকে দুর্ঘটনা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শুল্ক দফতর সূত্রের খবর, পণ্যভর্তি ট্রাকের সংখ্যা বাড়লেও বাণিজ্যের পরিমাণ কিন্তু বাড়েনি। বাড়ছে না রাজস্ব আয়ও। দৈনিক গড়ে ৩৫০ থেকে ৩৭৫টি ট্রাক এখন বেনাপোলে যাচ্ছে। বেনাপোল থেকে রোজ ১৭৫ থেকে ২০০টির মতো ট্রাক আসছে। ঘোজাডাঙার ‘অচলাবস্থা’-র পর পেট্রাপোলের অবস্থাটা ঠিক কী রকম? শুভেনবাবুর কথায়, “ঘোজাডাঙা দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় এই বন্দরে পণ্যভর্তি ট্রাকের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি একদিনে ৪২৩টি ট্রাক বেনাপোলে গিয়েছে।”
শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে দৈনিক ৫০-৬০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ঘোজাডাঙা সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকায় এই বন্দরে ট্রাকের সংখ্যা বাড়লেও ব্যবসা সেই অনুপাতে বাড়ছে না।
এর কারণ কি?
শুভেনবাবুর মতে, “পচনশীল পণ্যের তুলনায় অন্য সাধারণ পণ্যর (যন্ত্রপাতি, ফ্যাব্রিকস) আর্থিক মূল্য বেশি। কিন্তু পচনশীল পণ্যর ট্রাক আগে পাঠাতে গিয়ে অন্য পণ্যভর্তি ট্রাক পাঠাতে দেরি হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যের অর্থকরীর দিক থেকে পরিমাণ বাড়ছে না।” তা ছাড়া পেট্রাপোল থেকে পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে ‘কারপাস’ নিয়ে ট্রাক গেলেও পণ্য দিনের দিন খালাস করা হচ্ছে না। দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে চাইলেও বেশি ট্রাক পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।
যদিও পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা বাড়ায় খুশি ব্যবসায়ীরা। রোজগার বাড়ায় খুশি ক্লিয়ারিং এজেন্টরাও। শ্রমিকদের কাজও বেড়েছে। স্থানীয় গুদাম মালিকরাও লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ চাপ বেড়ে যাওয়ায় টান পড়েছে শ্রমিকের জোগানে।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্যের জন্য চালু করা হয়েছে ‘পুরো’ সময়ের জন্য ইলেকট্রনিক ডাটা ইন্টারচেঞ্জ (ইডিআই) ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থায় বাণিজ্যের নথিপত্রের কাজ সবটাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়। কোনও কারণে ইন্টারনেটের লিঙ্ক পাওয়া না গেলে বাণিজ্যের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। গত এক মাসে লিঙ্ক না থাকায় তিন দিন বাণিজ্যের কাজ বন্ধ ছিল। সোমবার থেকেও লিঙ্ক ভাল না থাকায় বাণিজ্যের কাজ শ্লথ হচ্ছে। ফলে সড়কে ট্রাক আরও বাড়ছে।
অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “লিঙ্ক না থাকলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নথিপত্রের চালু রাখার দাবি করা হয়েছে শুল্ক দফতরের কাছে।”
ট্রাকগুলির পরীক্ষা পদ্ধতি আরও দ্রুত করা, বাংলাদেশে ট্রাক চালক ও খালাসিদের থাকলে হলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলে বাণিজ্যের গতি আরও বাড়বে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
|
পেট্রাপোলে গণ্ডগোল |
যে সব কারণে পেট্রাপোল বন্দরে সমস্যা হচ্ছে |
• পচনশীল পণ্যের ট্রাক আগে খালাস করার কারণে অন্যান্য পণ্যবোঝই ট্রাক খালাসে দেরি। পার্কিং সমস্যার জন্য ট্রাকের লম্বা সারি।
• দ্রুত বাণিজ্যের জন্য চালু হওয়া ইডিআই (ইলেকট্রনিক ডেটা এক্সচেঞ্জ) ব্যবস্থা মাঝেমধ্যে বিকল হয়ে পড়া। বিকল্প ম্যানুয়াল পদ্ধতি চালু নেই।
• বন্দরে পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা বাড়ছে (ঘোজাডাঙা সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায়)। সেই তুলনায় বাড়তি শ্রমিকের অভাব।
• সিডব্লুসি-র ট্রাক টার্মিনাসে জায়গা অকুলান। সমস্ত ট্রাক দাঁড়ানোর মতো পরিকাঠামো নেই। ফলে যশোহর রোডের দু’ধারে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় যানজট, দুর্ঘটনার আশঙ্কা। |
|