টানা বনধের পথে গুরুঙ্গ, চাইলেন রাষ্ট্রপতি শাসনও
যে গার্ডেনরিচ-কাণ্ড নিয়ে রাজ্য সরকার এখন কোণঠাসা, তাকে অস্ত্র করে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুললেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। একই সঙ্গে আলাদা রাজ্যের দাবিতে ‘অন্তিম লড়াইয়ের’ও ডাক দিলেন তিনি। সেই সূত্রে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলনসূচিতে পাহাড়ে বনধ ছাড়াও সরকারি দফতর লাগাতার বনধের কথা ঘোষণা করেছেন গুরুঙ্গ।
রবিবার কালিম্পঙে দলীয় জনসভায় আক্রমণাত্মক গুরুঙ্গ বলেন, “জিটিএ (গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) চুক্তির পর থেকে দেখছি, রাজ্য সমানে চুক্তিবিরোধী কাজ করছে। রাজ্যে প্রশাসন বলেও কিছু নেই মনে হচ্ছে।” এর পরেই তিনি গার্ডেনরিচ প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, “গার্ডেনরিচে পুলিশের সামনে এক জন গুলি করে এক পুলিশকে খুন করল। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কী হতে পারে! এই রাজ্যে যে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই, তা ওই ঘটনায় ফের স্পষ্ট। এর পরে তো দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হতে পারে। শীঘ্রই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করব। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি-শাসন জারি করে পৃথক গোর্খাল্যান্ড গড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করব।”
কালিম্পঙের জনসভায়। রবিবার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে মালদহে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “পাহাড়ে একটা অশান্তি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। তবে সাধারণ পাহাড়বাসী মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষেই রয়েছেন।”
কালিম্পঙের সভা থেকেই এ দিন গুরুঙ্গ আলাদা রাজ্যের দাবিতে ‘অন্তিম লড়াই’-এর ডাক দেন। তাঁর দাবি, “জিটিএ-র আয়ু আর বেশি দিন নয়। আমরা অন্তিম লড়াইয়ে নামছি।” এর পরেই তাঁর ঘোষণা, ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে পাহাড়ে মিটিং-মিছিল হবে। ৯ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত পাহাড়ে কোনও সরকারি অফিস খুলতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছেন মোর্চা সভাপতি। সেই সঙ্গে ১৪ ও ১৫ মার্চ এবং ২১ ও ২২ মার্চ দার্জিলিং পাহাড়ের তিন মহকুমায় বন্ধ ডেকেছে মোর্চা। গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে ওই বন্ধ হলে পাহাড়ে চা ও পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সে প্রসঙ্গে গুরুঙ্গের মন্তব্য, “এটা আমাদের অন্তিম লড়াই। আশা করি, সে জন্যই পাহাড়ের মানুষ ক্ষতি স্বীকার করবেন।”
কালিম্পঙের সভাকে ঘিরে এ দিন সকাল থেকেই পাহাড় জুড়ে মোর্চার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ‘উন্মাদনা’ ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে কাতারে-কাতারে মানুষ জড়ো হন সভায়। মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মোর্চার নেত্রীরা সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘন ঘন স্লোগান দেন।
সম্প্রতি কিছু মোর্চা সমর্থক তাঁর সামনে আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চেহারা দেখেছিল পাহাড়। তার পরে মমতার সমালোচনায় ক্রমশ গলা চড়িয়েছে মোর্চা। গোর্খা লিগের নিহত নেতা মদন তামাঙের স্ত্রী ভারতী তামাঙের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার বা মদন তামাং হত্যা মামলায় শুক্রবারই মোর্চার পাঁচ নেতা গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে গুরুঙ্গের এ দিনের সুর চড়ানোর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন পাহাড়ের রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।
কালিম্পং স্টেডিয়ামে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পোস্টার।
গুরুঙ্গের বক্তব্য, পাহাড়ের অনগ্রসর সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সংক্রান্ত দফতর জিটিএ-কে হস্তান্তর করেছে রাজ্য। সে জন্য গত নভেম্বরে রাজ্য লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গড়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ করতে চাইলে মোর্চা আপত্তি করে। গুরুঙ্গের ক্ষোভ, “লেপচাদের সঙ্গে গোর্খাদের বিরোধ বাধিয়ে ফায়দা তুলতে চান মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য তো আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে! তাদের সঙ্গে গোর্খাল্যান্ডপন্থী লেপচাদের কেউ যাবেন বলে আমি মনে করি না।”
ঘটনাচক্রে হুগলির চুঁচুড়ায় এ দিনই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে পাহাড়ে ভাগ করছে রাজ্য সরকার।” মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “উনি মুরগির লড়াই লাগাতে চাইছেন।” আবার কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি মমতা-সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, এ ভাবে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকলে তাঁরা কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চাইতে বাধ্য হবেন।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, এ দিন আরও এক বার সিপিএমের প্রশংসা শোনা গেল গুরুঙ্গের মুখে। তিনি বলেন, “সিপিএম অনেক ভাল দল। ওঁদের একটা স্পষ্ট নীতি ছিল। এখন যেন স্বৈরতন্ত্র চলছে।” মোর্চা সভাপতির হুঁশিয়ারি, “আলাদা গোর্খাল্যান্ডের প্রশ্নে গোটা পাহাড় এককাট্টা। মনে রাখতে হবে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়ে কোনও সরকার, কোনও দল বেশি দিন চলতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী কার পরামর্শে এ সব করছেন জানি না।”
জিটিএ চুক্তির প্রাক্কালে ও কিছু দিন আগে পর্যন্ত তৃণমূলের তরফে যিনি পাহাড়ের নানা বিষয় দেখভাল করছেন, সেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব এ বিষয়ে এখন কোনও মন্তব্য করতে চান না। এ দিনও করেননি। তৃণমূল সূত্রের খবর, পাহাড়ের বিষয়টি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী ও কলকাতার এক শীর্ষ নেতা দেখাশোনা করছেন বলে গৌতমবাবুর মুখে কুলুপ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির একাধিক শীর্ষ নেতার খেদ, পাহাড়ের বিষয়টি ভালমতো না বুঝে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ কলকাতার এক নেতার পরামর্শে মোর্চাকে এড়িয়ে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গড়ে সমস্যার সূত্রপাত করেছেন। গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে ফের পাহাড় অশান্ত হলে তরাই ও ডুয়ার্সেও প্রভাব পড়বে। দল ও সরকারের তরফে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে পদক্ষেপ না করা হলে সমস্যা জটিল হবে।
সব দলকে নিয়ে বৈঠক করে পাহাড়-সমস্যার সমাধান সূত্র বার করায় জোর দিয়েছে সিপিএমও। দলের দার্জিলিং জেলার কার্যকরী সম্পাদক জীবেশ সরকার, প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য একযোগে বলেন, “মোর্চাকে এড়িয়ে যে ভাবে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গড়া হয়েছে তাতে পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতির দায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে। আমরা রাজ্যের কাছে অতি দ্রুত সর্বদল সভা ডাকার দাবি করছি।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও সর্বদল বৈঠকের পক্ষে। তবে তাঁর সংযোজন, “পাহাড়-সমতলে বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছিল সিপিএম। তৃণমূল সেটাই বাড়িয়ে পাহাড়ে গোর্খা এবং লেপচাদের বিভাজন করছে।” তবে তৃণমূল শীর্ষ নেতা মুকুলবাবুর দাবি, “আমরা বিভাজনের রাজনীতি করি না।”

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.