কলকাতার বাইরে কি কবি নেই?
ঔপন্যাসিক? ছোটগল্প লেখক? প্রাবন্ধিক?
লাভপুরের তারাশঙ্কর, বনগাঁর বিভূতিভূষণ বা প্রবাসী বনফুলের মতো প্রাচীনদের কথা না হয় বাদই রইল। হালে জয় গোস্বামী শিয়ালদহে এসে নেমেছেন রানাঘাট লোকালে চড়ে। জলপাইগুড়ির চা-বাগান থেকে এসে বাংলা গদ্যের দখল নিয়েছেন সমরেশ মজুমদার। শেষ জীবনে ঠাকুরনগরে একান্তবাস বেছে নেওয়া বিনয় মজুমদার তো চিরটাকাল এড়িয়েই গিয়েছেন কলকাতাকে।
কিন্তু প্রকাশক? নেই বললেই হয়।
সদ্য শেষ হওয়া কলকাতা বইমেলা দেখিয়ে দিল, বই আপনি যেখানে বসেই লিখুন, ঠিকঠাক ছেপে বাঁধিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে গেলে মহানগরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। আসানসোল-দুর্গাপুর বা শিলিগুড়ি, যত ব্যস্ত শহরই হোক, বই বার করতে হলেই কলকাতামুখো হতে হচ্ছে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা বার করার লোক তবু আছে। কিন্তু শুধুই বই ছাপেন, জেলার এমন প্রকাশক মেলায় খুঁজে পাওয়া ভার।
কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা যাঁরা করেন, সেই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড-এর ছাপানো বিগত কয়েক বছরের ‘বুকস্ ইন প্রিন্ট’-এ প্রায় ৪০টিরও বেশি এমন প্রকাশনা সংস্থার নাম ছিল, যাদের ঠিকানা বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু এ বারের বইমেলায় খুঁজে পাওয়া গেল হাতে গোনা চার-পাঁচটিকে। তার একটি হাওড়ার ‘সহজপাঠ’। আবার বীরভূমের পরিচিত প্রকাশনা ‘রাঢ়’-এর পরিবেশকও তারাই। স্টলে দুই সংস্থারই বই রাখা। |
জেলার লেখকদেরও ভরসা সেই কলকাতার প্রকাশনা। |
‘রাঢ়’-এর কিশোর দাসের দাবি, “জেলায় যথেষ্ট ভাল মানের কাজ হচ্ছে। অনেকেই নানা গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করছেন। এ বার বইমেলায় আমরা ১০০ বছরের পুরনো শিবরতন মৈত্রের ‘সাঁজের কথা’ নামে একটি দুষ্প্রাপ্য রূপকথা সঙ্কলন প্রকাশ করেছি।” কিন্তু ‘বইওয়ালা’ প্রকাশনার উৎপল মৈত্র একমত হতে পারেননি। একদা শিলিগুড়ি থেকে ওই প্রকাশনা সংস্থা চালাতেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই তা কলকাতায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। তাঁর মতে, “সে ভাবে বলতে গেলে, নিয়মিত বই ছাপায়, তা বিক্রিও হয়, জেলায় এমন পেশাদার কোনও প্রকাশকই নেই!”
কোনও পত্রিকার উপরে নির্ভর করে অন্য প্রকাশনার কাজও করছেন, এমন প্রকাশক জেলায় বেশি। যেমন পুরুলিয়ার ‘নাটমন্দির’। মূলত পত্রিকা-নির্ভর প্রকাশনা হলেও কয়েক বছর ধরে তারা স্বতন্ত্র বইও বার করছে। কোচবিহারের সাহিত্যিক, প্রয়াত অরুণেশ ঘোষের গল্পসংগ্রহ বার করেছে তারাই। সংস্থার কর্ণধার রঞ্জন আচার্য বলেন, “জেলা থেকে যে প্রকাশকেরা উঠছেন, তাঁরা কলকাতার উপরেই নির্ভরশীল।”
ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র মনে করিয়ে দেন, “এক সময়ে জেলার প্রকাশনা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। বিশেষ করে যখন পূর্ববঙ্গ ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গে বরাবরই জেলার প্রকাশনা কম, যা-ও বা ছিল তা বৈষ্ণব ধর্মের। এগুলো নিয়ে এখনও কোনও ইতিহাস লেখা হয়নি।”
কলকাতামুখিনতার কারণ হিসেবে ‘লোক’ প্রকাশনীর প্রণব সরকার, ‘সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথ মজুমদার, ‘উত্তর-দক্ষিণ’ পত্রিকার সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় বা ‘বইওয়ালা’র উৎপল মৈত্র বলছেন বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা। এক, জেলায় বই ছাপানোর খরচ বেশি, মানও খারাপ। ভাল প্রুফ রিডার বা বাইন্ডার্সেরও অভাব। দুই, বিপণনের জন্য কলকাতার উপরেই নির্ভর করতে হয়। তা বাদে থাকে কিছু জেলা বইমেলা বা লিটল ম্যাগাজিন মেলা। তাতে ব্যবসা চলে না।
উৎপলবাবুর কথায়, “শিলিগুড়ি থেকে আমি যদি কিছু প্রকাশ করি, সেটা তো কলকাতায় আনতেই হবে। শিলিগুড়ি থেকে তা পাঠাতেই খরচ পড়বে এক হাজার টাকা। উল্টো পথে একই জিনিস কলকাতা থেকে পাঠাতে কিন্তু খরচ মোটে একশো টাকা!” সুদীপ্তবাবু বলেন, “বইমেলার সামান্য বিক্রির উপরে তো প্রকাশকেরা নির্ভর করে থাকতে পারেন না। বাজার না থাকলে প্রকাশক বাঁচবে কী করে?” কলকাতার তালপাতা প্রকাশনীর গৌতম সেনগুপ্তর বক্তব্য, “বইয়ের বাজার আছে ঠিকই। কলকাতাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।”
জেলার দুর্দশার তিন নম্বর কারণ যদি হয় প্রচার ও লোকবলের অভাব (সরকারি সহায়তাও মেলে না), নামী লেখকেরা তাঁদের বই দিতে আগ্রহী নন বলেও স্থানীয় প্রকাশকদের একটা বড় অংশের অনুযোগ। শিলিগুড়ির বাসিন্দা, বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক অশ্রুকুমার শিকদারের স্পষ্ট উত্তর, “জেলায় তেমন ভাল প্রকাশক আছে বলেই আমি জানি না। ফলে তাঁদের কাছে বই প্রকাশ করতে দেওয়ারও তো প্রশ্ন ওঠে না!”
লেখকদের বীতরাগের কারণও আছে। জেলার প্রকাশকেরাই দুষছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীকে, যাঁরা আগ্রহী লেখকদের থেকে অস্বাভাবিক টাকা নিয়ে বই ছাপছেন। কিন্তু বিপণনের ব্যবস্থা করছেন না। এঁদের জন্যই জেলার লেখকেরা আরও বেশি কলকাতামুখো হচ্ছেন বলে মত অনেকের। তবে প্রকাশকদের মতে, এমন কিছু লোকের কারণে গুটিয়ে না গিয়ে বরং কলকাতার একাধিপত্য খর্ব করতে প্রতিষ্ঠিত লেখকদেরই এগিয়ে আসা উচিত। প্রণববাবুর কথায়, “লেখক চাইবেনই, তাঁর বই যেন ভাল প্রচার পায়, বিপণন হয়। নতুন প্রকাশকদের উৎসাহ দেওয়াটাও উচিত জেলার বড় লেখকদের। তাঁরা আমাদের পাশে থাকুন, এটাই চাই।” |