মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাহিলে যে দ্রুত কাজ করিতে পারেন, তাহা স্বয়ং তিনি বিচিত্র ধ্বন্যাত্মক অব্যয়সহ বুঝাইয়া বলিয়াছেন। প্রমাণও করিয়াছেন দময়ন্তী সেন হইতে রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সেই সাক্ষ্য বহন করিতেছেন। এবং, তাঁহার পৌনে দুই বৎসরের শাসনকালে যে তিনি রাজ্যের ৯০ হইতে ৯৮ শতাংশ সমস্যার সমাধান করিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাও মুখ্যমন্ত্রী স্বপ্রবৃত্ত হইয়াই জানাইয়াছেন। অতএব, কোনও তর্কশীল বঙ্গসন্তান যদি দাবি করেন, এই রাজ্যে এখনও যে সমস্যাগুলি অবশিষ্ট রহিয়াছে, সেগুলিকে মুখ্যমন্ত্রী ‘সমস্যা’ হিসাবে বিবেচনাই করেন না, এবং তাহার সমাধান করিতে চাহেন নাই, তবে সেই দাবিকে মুখ্যমন্ত্রী উড়াইয়া দিতে পারিবেন না। সেই তর্কশীল ব্যক্তি অতঃপর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রের কথা পাড়িবেন। বলিবেন, রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে ৩৪,৫০০ শিক্ষকের পদ শূন্য পড়িয়া আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৫৫,০০০, কলেজে ১৮০০। বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতায় পদগুলিতে নিয়োগ বন্ধ। গত পৌনে দুই বৎসরে মুখ্যমন্ত্রী এই দিকে দৃষ্টিপাত করিতে সময় পান নাই। মুখ্যমন্ত্রীর মতে পরিস্থিতিটি কি তবে ‘সমস্যা’ হিসাবে বিবেচিত হইবার অযোগ্য?
মুখ্যমন্ত্রীর সমস্যা মাপিবার মাপকাঠি ঠিক কী, তাহা অজ্ঞাত। কিন্তু শিক্ষকের অভাব প্রকৃত প্রস্তাবে একটি দ্বিমুখী সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গে কখনও শিল্প তেমন ভাবে বাড়িতে সুযোগ পায় নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার কথা আর না বলাই ভাল। এই রাজ্যে সরকারি চাকুরিই ভরসা। সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৪,৫০০ পদের জন্য প্রায় ৫৫ লক্ষ আবেদনপত্র জমা পড়িয়াছিল প্রতি পদের জন্য প্রার্থীর সংখ্যা গড়ে ১৬০ জন। এই বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে সরকারি চাকুরির মুখ চাহিয়া আছে। ২০০৬ সাল হইতে প্রাথমিক স্তরে নিয়োগ বন্ধ। যে ছেলেমেয়েগুলি সরকারি জটিলতায় চাকুরিহীন বসিয়া থাকিতে বাধ্য হইতেছে, তাহাদের সমস্যা মুখ্যমন্ত্রীর বুকে বাজে না? তাহারা কি যথেষ্ট মা-মাটি-মানুষ নহে? অন্য দিকে, শিক্ষকের অভাবে সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত গ্রাহ্যসীমার বহু ঊর্ধ্বে উঠিয়া গিয়াছে। যেখানে প্রতি ৪০ জন ছাত্রের জন্য কমপক্ষে এক জন শিক্ষক থাকা উচিত, সেখানে বহু স্কুলে ১২০ জন ছাত্রের জন্য মাত্র এক জন শিক্ষক আছেন। পঠনপাঠনে কী অবহেলা হইতেছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী বিপুল ক্ষতি হইতেছে, মুখ্যমন্ত্রী বুঝিতেছেন কি? না কি, শিশুদের ভোট নাই বলিয়া তাহাদের সমস্যা ঠিক ‘সমস্যা’ নহে?
মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম কর্তব্য, এই পরিস্থিতিকে ‘অতি মারাত্মক সমস্যা’ হিসাবে দেখা। দ্বিতীয় কর্তব্য, বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করিয়া তাহার সমাধানের জন্য যাহা করণীয়, করিয়া ফেলা। আদালতে যে মামলাগুলি ঝুলিয়া আছে, তাহার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। যে জট বাঁধিয়া আছে, তাহা সমাধানের অতীত নহে। সদিচ্ছা থাকিলে, চেষ্টা থাকিলে সমাধান সম্ভব। প্রশ্ন হইল, মুখ্যমন্ত্রীর সেই ইচ্ছা আছে কি? থাকিলে, করিয়া দেখান। |