পুলিশ ও প্রশাসন আপাতত বহু-আলোচিত। বিতর্কিতও। এই বিতর্কে একটি মূল প্রশ্ন যথারীতি হারাইয়া গিয়াছে। অস্ত্রের বেআইনি প্রসার ও অপব্যবহারের প্রশ্ন। প্রশ্নটি কিন্তু উঠিয়াছিল। দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত কলিকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর কন্যা যখন জানিতে চাহিয়াছিলেন, ‘ওই ছেলেটা অস্ত্র পেল কেমন করে’, যখন প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকিলেও তাহা কেন আত্মরক্ষায় বা নিরস্ত্র জনসাধারণের প্রাণরক্ষায় ব্যবহৃত হইতে পারে না, অথচ দুষ্কৃতী প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া আস্ফালন করে ও তাহা পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার দুঃসাহসও দেখায়, তখন কেবল বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ির সমস্যাটি উঠিয়া আসে না, সেই সঙ্গে দুষ্কৃতীদের প্রতি পুলিশ প্রশাসন ও তাহাকে নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ শাসক দলের মনোভাবের সমস্যাটিও স্পষ্ট হয়। অবশ্যই ইহা জটিল ও বৃহৎ সমস্যা। তবে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ চোরাচালান এবং রাজনৈতিক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দ্বারা তাহার যথেচ্ছ ব্যবহার একটি পুরানো সমস্যা। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই সমস্যা বিপুল কলেবর ধারণ করিয়াছিল। সেই জমানার শেষ পর্বে প্রথমত খেজুরি বনাম নন্দীগ্রাম বিরোধে, তাহার পর জনগণের কমিটি প্রভাবিত জঙ্গলমহল হইতে মাওবাদীদের উৎখাত করার অধ্যায়ে তাহা ভয়াবহ হইয়া ওঠে। উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশ নয়, বরং পুলিশ প্রশাসনকে ঠুঁটো করিয়া রাখিয়া শাসক সিপিআইএম সমর্থিত দুষ্কৃতীরা ওই সব বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের সম্ভার লইয়া কার্যত তাণ্ডব চালাইয়াছে। সেই সময়েও কোনও বৃহৎ অপকাণ্ডের পর (যেমন নেতাই গণহত্যার পর) বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব উঠিয়াছে। সেই দাবিতে বিরোধীরা সরবও হইয়াছেন। কিন্তু রাজ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথা পুলিশের তরফে যথার্থ কোনও তৎপরতা দেখা যায় নাই।
সরকার বদল হইলেও রাজ্যে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের প্রসার ও ব্যবহার অব্যাহত। কলিকাতা বন্দর এলাকার একটি কলেজের ছাত্র-সংসদের নির্বাচনে এমনই এক অপকাণ্ডে দুষ্কৃতীর ওয়ান-শটার পিস্তলে এক সাব-ইন্সপেক্টরের হত্যা এই সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার দাবিকেই জোরদার করিয়াছে। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলিতেছেন। তাঁহার প্রতাপ প্রতিপত্তি যত বেশিই হউক, তাঁহার মুখের কথা শুনিয়া শমীবৃক্ষে লুকানো অস্ত্রগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসিয়া আত্মসমর্পণ করিবে, এমন ভরসা কম। ফিরহাদ হাকিমদের সরকারের বয়স দুই বছর হইতে চলিল। হাঁটি হাঁটি পা পা করিলেও দুই বছরে অনেক কাজ করা যায়। কথা না বলিয়া কাজ করুন। মুখ্যমন্ত্রী হইতে ফিরহাদ হাকিম অবধি সকলেই নাকি চ্যালেঞ্জ লইতে ভালবাসেন। এই একটি চ্যালেঞ্জ লইলে রাজ্যের উপকার হয়, কিছু প্রাণ বেঘোরে চলিয়া যায় না। আর কিছুই না পারেন, অন্তত বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করিয়া দেখান, ইহা বামফ্রন্ট জমানা নহে, পরিবর্তনের সরকার রাজ করিতেছে।
অদূরেই রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। গ্রামে-গঞ্জে ইতিমধ্যেই যে সংঘাত দেখা যাইতেছে, যে ভাবে প্রতিপক্ষকে ভোটে দাঁড়াইতে না-দিবার, অর্থাৎ মনোনয়নপত্র পর্যন্ত জমা দিতে না-দিবার হুমকি প্রকাশ্যে দেওয়া হইতেছে, তাহাতে ওই নির্বাচন ঘিরিয়া তীব্র ও ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি স্বাভাবিক। আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত দুষ্কৃতীদের পক্ষে ইহাই নিজেদের কার্যকারিতা প্রমাণের সুবর্ণ সুযোগও বটে। যে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ইতিমধ্যেই এই রাজ্যের আনাচেকানাচে মজুত এবং নিয়ত আরও সরবরাহ হইতেছে, তাহা বাজেয়াপ্ত না করিলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেগুলির ব্যবহার রোধ সম্ভব হইবে না। কাহার কাছে কী আগ্নেয়াস্ত্র আছে, কোন এলাকায় কাহারা দুষ্কৃতী, তাহাদের আশ্রয়স্থল কোথায়, প্রশ্রয়দাতা কোন রাজনীতিকরা, এ সকল নিশ্চয়ই পুলিশ প্রশাসনের অজানা নহে। কাজ করার জন্য পুলিশের দরকার রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের আগাম সবুজ-সংকেত। মিলিবে? |