টাকার অভাবে পুর বাজারের উন্নয়ন থমকে যাওয়ায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর সাহায্য নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। কিন্তু সেই উদ্যোগ কার্যত বিফল বলেই মনে করছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। কলেজ স্ট্রিট, লেক, ল্যান্সডাউন ও পার্ক সার্কাস এই চারটি বাজার বেসরকারি হাতে দিয়ে চরম শিক্ষা পেয়েছে পুর প্রশাসন। কোনওটিতেই পরিকল্পনামাফিক আধুনিকীকরণের কাজ এগোয়নি। অগত্যা এ বার পিপিপি-র ভরসা ছেড়ে আর্থিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজেরাই পুর-বাজারের আধুনিকীকরণের কাজে নামতে চান তাঁরা। সম্প্রতি পুর কমিশনার-সহ পুরসভার পদস্থ অফিসারদের নিয়ে এ ব্যাপারে জরুরি বৈঠক করেন পুর-বাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ তারক সিংহ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাডকোর প্রতিনিধিরাও।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঋণের জন্য উৎসাহী ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করবে পুরসভা। পুর-বাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক অফিসার জানান, ইতিমধ্যেই হাডকো এবং এইচডিএফসি পুরসভাকে ঋণ দেওয়া নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পুরসভার অর্থ দফতরকে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করার ভার দেওয়া হয়েছে। |
(বাঁ দিকে) লেক মার্কেট, (ডান দিকে) কলেজ স্ট্রিট মার্কেট। —ফাইল চিত্র |
অর্থাৎ এ বার থেকে পুরসভাই পুর-বাজারের পরিকাঠামো উন্নয়নের পথে পা বাড়াল। তবে পুরসভা যা-ই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য পিপিপি মডেলকেই বেশি গুরুত্ব দেন। সে ক্ষেত্রে পুরকর্তাদের এই নয়া সিদ্ধান্ত কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে।
তা সত্ত্বেও কেন পিপিপি-র বিকল্প পথে হাঁটতে চাইছে পুরসভা?
পদস্থ অফিসারদের ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নতুন করে কোনও পুর বাজারের আধুনিকীকরণে পিপিপি-র সহায়তা নেওয়া হবে না। বৈঠকের গৃহীত সিদ্ধান্তের ৪ নম্বর সূচিতে বলা হয়েছে, রেকর্ড অনুযায়ী পিপিপি যুক্ত বেসরকারি সংস্থারা পুরসভার সম্পত্তি (জমি) দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছে। এক জনের জমি, অন্য জনের টাকা নিয়ে মুনাফা করছেন তাঁরা। পুরসভা সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে আধুনিকীকরণের কাজ করলে আরও ভাল হবে। বিষয়টি মেয়র পারিষদ বৈঠকে তোলা হবে বলে জানান পুরকর্তারা। তা ছাড়া, সময়ে কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই সব বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে।
এক পুর অফিসার জানান, কলেজ স্ট্রিট, ল্যান্সডাউন ও লেক মার্কেট আধুনিকীকরণের জন্য পিপিপি মডেলের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। এর কোনওটাই এখনও গড়ে ওঠেনি। মেয়র পারিষদ তারক সিংহ জানান, ১৯৮৬ সালে ল্যান্সডাউন মার্কেট আধুনিকীকরণের কাজ পেয়েছিল একটি সংস্থা। ২৭ বছর হল, এখনও ৫ শতাংশও কাজ হয়নি। ২০০৫ সালে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের কাজ হাতে নিয়েছিল অন্য একটি সংস্থা। ১৮ মাসে ওই বাজার সম্পূর্ণ করার কথা ছিল। ৮ বছর হল, এখনও ৩০ শতাংশ কাজও হয়নি। একই সময়ে শুরু হওয়া লেক মার্কেটও আটকে রয়েছে এখনও। পুরকর্তাদের মতে, ওই চারটি বাজারের অভিজ্ঞতা থেকেই পিপিপি মডেল সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। কাজে এত ঢিলেমি কেন, তার কারণ জানতে কলেজ স্ট্রিট ও ল্যান্সডাউন মার্কেটের স্থপতি সংস্থাকে পুরসভায় ডাকা হচ্ছে বলে জানান তারকবাবু।
পুর সূত্রের খবর, পুরসভার অধীনে ৪৬টি বাজার আছে শহরে। সম্প্রতি পুর-বাজারগুলির বর্তমান হাল নিয়ে সমীক্ষা করা হয়। তারকবাবুর কথায়, “প্রায় সব বাজারেই আয়ের থেকে ব্যয় অনেক বেশি। আর দিনের পর দিন তা বেড়েই চলেছে।” তাঁর মতে, প্রতিটি বাজারের উন্নয়ন দরকার। বাজারের পরিকাঠামো বাড়িয়ে অন্য ভাবে আয়ের উৎস বাড়াতে হবে। এ নিয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। ঠিক হয়েছে, বাজারগুলির আধুনিকীকরণে সময় বেঁধেই হাত দিতে হবে পুর প্রশাসনকে। একই সঙ্গে পুর বাজারের একাধিক অফিসারের মতে, বাজারের দোকানগুলির ভাড়াও কম। তা বাড়ানো দরকার। তবে পুর-বাজারের ভগ্নদশা না সারিয়ে ভাড়া বাড়ানোর পথে হাঁটতে চাইছেন না তাঁরা।
সমীক্ষার রিপোর্ট দেখে তারকবাবু জানান, দীর্ঘদিন ধরে দোকানদারদের ভাড়ার টাকা বাকি পড়ে রয়েছে। আলোর ব্যবহারেও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যাঁর বরাদ্দ ১০০ ওয়াট, তিনি ব্যবহার করছেন অনেক বেশি। ফলে বিদ্যুতের বিলও বেড়েই চলেছে। ওই বিল দিতে হয় পুরসভাকে। অথচ তা দেখভালের জন্য অফিসার-কর্মী-নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। শুধু তারকবাবু নন, ওই দফতরের পূর্বতন মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারও পুর-বাজার উন্নয়নে পিপিপি-র ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, “পুরসভা নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলির অবস্থা ভাল ছিল না, ভেঙে পড়ছিল। গত বোর্ডের আমলে কলেজ স্ট্রিট ও লেক মার্কেট আধুনিকীকরণ করার দায়িত্ব পিপিপি মডেলে দেওয়া হয়। যে দু’টি সংস্থা ওই কাজ পেয়েছেন, এখনও তাঁরা মার্কেট চালু করতে পারেননি।” দেবাশিসবাবু বলেন, “আধুনিকীকরণের নামে বছরের পর বছর তো আর অপেক্ষা করা যায় না। ব্যবস্থা নিতে হবে পুর-কর্তৃপক্ষকেই।” যদিও আর্থিক সংস্থার থেকে ঋণ নিয়ে পুর-বাজার উন্নয়নের বিষয়টি নাকি জানেনই না মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এ সব নিয়ে একটা বৈঠক হয়েছে, এমন কোনও খবর জানি না।”
তবে ৪ ফেব্রুয়ারি মেয়রের ঘরের সামনেই কনফারেন্স রুমে ওই বৈঠক হয়। এ দিকে, হাডকোর পক্ষ থেকে সংস্থার রিজিওনাল চিফ পুরসভাকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে একটি চিঠিও দিয়েছেন। আগামী দিন কয়েকের মধ্যেই পুরো বিষয়টি মেয়র পারিষদের বৈঠকে তোলা হবে বলে পুর সূত্রের খবর। |