পরিস্থিতির রাশ হাতে নিতে ১৫ নম্বর বরোর তৃণমূল চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না গত ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচে বড় ধরনের গোলমাল পাকানোর পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তদন্তে জেনেছেন সিআইডি গোয়েন্দারা। সেই অনুযায়ী কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী ঘটনাচক্রে এর ভিতরে ঢুকে পড়ায় মুন্নার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যায় বলেই মনে করছে সিআইডি। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, তার জেরেই ঘটনার অভিমুখ ভিন্ন দিকে ঘুরে যায়। গুলিতে মৃত্যু হয় তাপসবাবুর।
আলিপুর আদালতে কলকাতা পুলিশের পেশ করা এফআইআর খতিয়ে দেখে এবং ধৃতদের জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই দিন ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে প্রথমে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছিলেন মুন্না। আর গুলি চালনার ঘটনার পরে মহাকরণ ও লালবাজারকে বিভ্রান্ত করেন রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। তাপসবাবু গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ববি বলেছিলেন, ১৫ নম্বর বরোর তৃণমূল চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবালকে কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ মোক্তারের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাপস চৌধুরী। |
ভবানী ভবন থেকে সিআইডির সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে আসছেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা।
(বাঁ দিক থেকে)
বৈদ্যনাথ সাহা, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, পল্লবকান্তি ঘোষ, ভি সলোমন।—নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু আসল ঘটনা যে একেবারেই অন্য রকম, সেটা কলকাতা পুলিশের এফআইআর থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তদন্তকারীদের কাছে।
কলকাতা পুলিশের দায়ের করা এফআইআর-এর বয়ান খতিয়ে দেখে এবং ধৃত সেখ সুহান ও ইবনেকে জেরা করে সিআইডি দেখেছে, মুন্না ওই দিন আদৌ আক্রান্ত হননি। বরং তাঁর সঙ্গের লোকেরাই বিপক্ষ দলের উপরে হামলা চালিয়েছিল। সিআইডি-র দাবি, সেই হামলা মুন্নার ঘনিষ্ঠদের নির্দেশেই হয়েছে বলে সুহান তাদের জানিয়েছে। গোলমাল করার জন্যই সুহানদের সে দিন ওখানে আনা হয়েছিল বলেও জানতে পেরেছে সিআইডি।
এফআইআর-এর বয়ান উদ্ধৃত করে তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, মুন্নার প্ররোচনায় গার্ডেনরিচ থানার ওসি অন্যত্র সরে যাওয়ার পরে বিবদমান দুই পক্ষ মুখোমুখি চলে আসে। তখনই তাহির হোসেন নামে এক জনকে ধরে ফেলে মুন্নার দলের একাংশ। ধস্তাধস্তিতে তাহিরের জামা খুলে যায়। তাকে মুন্নার লোকেরা টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সেই সময় তাহিরকে বাঁচাতে গিয়েই তাপসবাবু গুলিবিদ্ধ হন বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাই মুন্নাকেই প্রধান অভিযুক্ত করে মামলা সাজাচ্ছে পুলিশ। প্রশাসনের শীর্ষ মহলের চাপ সত্ত্বেও তাঁকে যে ধরা হবে, তা বুঝেই মুন্না বুধবার রাতে গা ঢাকা দেন। মুন্নার ছেলে অনিলও ফেরার। মুন্নার গতিবিধি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন সিআইডি কর্তারা। এডিজি সিআইডি শিবাজি ঘোষের মন্তব্য, “গ্রেফতার হলেই জানতে পারবেন।” আর কলকাতা পুলিশের কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ বলেন, “বিষয়টি সিআইডি দেখছে।”
মুন্নাকে ধরা না-গেলেও ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি কী ভাবে ছক সাজিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে তাহির হোসেন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ঘটনার দিন মুন্নার লোকেরা তাহিরকে কেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার ব্যাখ্যা পুলিশের এফআইআর-এ বলা হয়নি। গার্ডেনরিচ থানার পুলিশ এবং ধৃতদের বয়ানের ভিত্তিতে তদন্তকারীদের মনে হয়েছে, তাহির ছিল একটা ‘টোপ’। শনিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া তাহির তদন্তকারীদের জানিয়েছে, সে তৃণমূল সমর্থক। তবে কেন তাকে মুন্নার দলবল মারধর করে জামা ছিঁড়ে দিল এবং পরে টানতে টানতে নিয়ে গেল, তা তার কাছে এখনও বিরাট বিস্ময়। নিহত সাব-ইনস্পেক্টর টেনে সরিয়ে না-দিলে তাঁকে যে মুন্নার লোকেরা মেরে ফেলত, সেটা তাহিরই জানিয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
কেন তাহিরকে ‘টোপ’ বানিয়েছিল মুন্নার দলবল? তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “পুরোটাই ঘটছিল পরিকল্পনা মাফিক। তাহির মারা গেলে বা আহত হলে তার দায় মোক্তার তথা কংগ্রেসের উপরে চাপিয়ে তাদের কোণঠাসা করে দিতে পারত মুন্নার লোকেরা। তার পরে পুরো এলাকার রাশ নিজেদের হাতে নিতে পারত তারা। কিন্তু মাঝখানে তাপসবাবু চলে আসায় সব বদলে যায়। যার জেরে এখন মুন্নাকেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে!” ওই অফিসার জানান, এলাকার থানায় কখনও ডিউটি না-করায় তাপসবাবু সম্ভবত মুন্না বা তাঁর দলবলকে চিনতেন না। তাঁদের ইচ্ছায় বাধা দিলে তার পরিণাম কী হতে পারে, সেই ধারণাও তাঁর ছিল না। একজন পুলিশ অফিসারেরা যা করা উচিত, সেটাই করেছিলেন তিনি।
আদালতে জমা দেওয়া কলকাতা পুলিশের এফআইআর-এ বলা হয়েছে, ‘আচমকাই ইকবালের দলের চার-পাঁচ জন মোক্তারের দলের এক যুবক (তাহির হোসেন)-কে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার তাপসবাবু ওই যুবককে ইকবালের দলের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। সেটা দেখেই ওই চার-পাঁচ জন যুবকের মধ্যে থাকা সুহান নামে এক যুবক আচমকাই আগ্নেয়াস্ত্র বার করে তাপসবাবুকে লক্ষ করে গুলি চালিয়ে দেয়।’ তাপসবাবুকে সে গুলি করল কেন, সেখ সুহানকে জেরা করে পুলিশ তা জানার চেষ্টা করছে।
বেপাত্তা মুন্নার সন্ধানে নেমে গোয়েন্দারা জেনেছেন, শুক্রবার ভিন রাজ্যের সিম ব্যবহার করে কথা বলেছিলেন তিনি। তার পর থেকে তাঁর সঙ্গে সব যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছে পুলিশ। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “আমরা তৌহিদ ও পারভেজ বলে মুন্নার দুই সঙ্গীকে আগে খুঁজে বের করতে চাই। ওঁরাই মুন্নার হাল হকিকত জানে। ওরাই মুন্নাকে কলকাতা থেকে পালাতে সাহায্য করেছে।” পুলিশের একটি মহলের আবার সন্দেহ, মুন্না বন্দর এলাকাতেই কোথাও লুকিয়ে আছেন।
তদন্তকারীদের ধারণা, পিপলু নামে এক দুষ্কৃতী অস্ত্র সরবরাহ করত ইবনে ও সুহানকে। কোথা থেকে ওই অস্ত্র আনা হত, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সুহানের কাছে সব সময় দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। তবে ঘটনার সময় সুহানের কাছে ক’টি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তা এখনও জানা যায়নি। যেমন গোয়েন্দারা এখন জানতে পারেননি, তাপসবাবুকে সুহান যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করেছিল, তা কোথায়। রবিবারও গার্ডেনরিচ কাণ্ডে অভিযুক্তদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলেছে।
তাপস চৌধুরী খুনের ঘটনায় এখনও অধরা মূল অভিযুক্ত-সহ একাধিক ব্যক্তি। এই অবস্থায় এখন থেকে সিআইডি ও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ একযোগে তদন্ত এমনকী প্রয়োজনে একসঙ্গে তল্লাশিও চালাবে বলে রবিবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, বন্দর এলাকার দুষ্কৃতীদের সম্পর্কে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দু’পক্ষের সমন্বয় বাড়াতে রবিবার দুপুরে ভবানী ভবনে সিআইডি-র সদর দফতরে বৈঠক করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ ও সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল। বৈঠকে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (বন্দর) ভি সলোমন এবং গার্ডেনরিচ থানার অফিসারেরাও ছিলেন। কলকাতা পুলিশের তরফে বন্দর এলাকার দুষ্কৃতীদের নামের একটি তালিকা
এ দিন সিআইডি-র হাতে তুলে
দেওয়া হয়। |