|
|
|
|
তারাবাজি |
ইরানি কাফে
আজ আর তিনি বলিউডের গোপাল ভাঁড় নন।
স্রেফ বোমান ইরানি। কথা বললেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
জন্মের ঠিক ছ’মাস আগে তাঁর বাবা মারা যান।
নিজের আজও ধারণা যে হয়তো ছেলেবেলায় ধরা না-পড়া ডিস্লেক্সিয়াতে ভুগতেন। আজও নম্বর গুনতে অসুবিধা হয়। ন’বছর বয়স পর্যন্ত ঠিক করে কথাও বলতে পারতেন না।
তবু বোমান ইরানিকে কোনও দিন তাঁর না পাওয়ার গ্লানি নিয়ে দুঃখ করতে শুনবেন না।
কারণ জিজ্ঞেস করলে একটাই কথা বলবেন তিনি, “আমি জীবনকে একটা অর্ধেক ভর্তি জলের গ্লাসের মতো দেখি। প্রত্যেক মানুষেরই কোনও না কোনও অসুবিধা আছে। অসুবিধার মধ্যে দিয়েও এগিয়ে চলতে হয়।”
আর সেটাই উনি প্রতিনিয়ত করে চলেছেন। চল্লিশ বছর বয়সে এসে সিনেমার শুরু। তার আগে ওয়েটারের চাকরি। সঙ্গে ফোটোগ্রাফি, থিয়েটার। আর তিপ্পান্ন বছর বয়সে, পিছনে ফিরে তাকালে দেখবেন অন্তত ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন।
সামনেই মুক্তি পেতে চলেছে ‘জলি এলএলবি’। তার পর রাজকুমার হিরানির সঙ্গে ‘পিকে’। রাজকুমারের সিনেমায় গল্প বলার ধরনে নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। আর ফারহা খানের সঙ্গে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। যাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘শিরিন ফারহাদ কি নিকল পড়ি’ ছবিতে। যাঁর সঙ্গে কাজ করা মানেই ‘ফান’।
স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে একটা সময় ছিল যখন ঘরে ঢুকলেই মানুষ মনে করতেন এই এক জন গোপাল ভাঁড় উপস্থিত। এতে কি কোনও চাপের সৃষ্টি হয় না? তবে আজকাল একটা তফাত বুঝতে পারেন। আগে স্ত্রীর সঙ্গে একটা শাড়ির দোকানে ঢুকলে যে ধরনের মানুষরা তাঁর ছবি তুলতে দৌড়ে আসতেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলো কিছুটা পাল্টে গিয়েছে। “শুধুমাত্র ‘হাসাতে পারি ভাল’ পরিচয়টাই আজ আর সবার কাছে বড় নয়। সে দিন এক ভদ্রলোক বললেন তাঁর বাবা আমার ছবি দেখতে পছন্দ করেন। আর সেই দেখে তিনি নিজেও আনন্দ পান! এই মানুষটির কাছে কিন্তু বোমান মানেই এক জন ন্যাপকিন মাথায় পরে সবাইকে আনন্দ দেওয়ার খোরাক নন।”
এটার জন্য কি অনেকটাই ‘ট্যুইটার’ দায়ী? সব সময় তো ওখানে উনি চুটকি শোনান না। মাঝে মধ্যে হয়ে যান ক্যুইজ মাস্টার। হোস্ট করেন ‘চায় গরম চায়’ ক্যুইজ। সিনেমা নিয়ে প্রশ্ন। তবে তার উত্তর গুগল-এ পাওয়া যাবে না। এই তো সেদিন এক জন ‘ট্যুইটার’-এ জিজ্ঞেস করে বসলেন যে উনি কি চা খেতে খেতে ক্যুইজ করেন নাকি? “এই ক্যুইজটা কিন্তু চা খেতে খেতেই প্রথম করতে শুরু করি। গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে হল লিখে দিলাম ‘চায় গরম চায়’। ভাবলাম দেখি তো কে কেমন ভাবে প্রতিক্রিয়া করছেন তিনটে শব্দতে। সেখান থেকেই শুরু।” |
|
এই তো সেদিন জিজ্ঞেস করলেন ‘শোলে’ ছবির আসল ভার্সনে গব্বরের কী হয়? লিখেছিলেন, ‘আমরা যেটা দেখেছিলাম সেটা পুনরায় শ্যুট করা হয়েছিল (সেন্সর/ গভর্মেন্ট প্রেসার)’। তার পর ইয়ার্কি মেরে জিজ্ঞেস করেন ক’জন গুগল করে উত্তর খুঁজছেন? শেষে নিজেই বলে দেন যে মূল ছবিটির শেষে ‘ঠাকুর গব্বরকে তাঁর স্পাইক জুতো দিয়ে সারা শরীরে লাথি মারতে থাকেন। গুঁড়িয়ে দেন তাঁর হাত।’ “প্রায় দেড় বছরের উপর ক্যুইজটা করছি। সিনেমা সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা রয়েছে আমার। শুধু প্রশ্ন করার ধরনে একটা নতুনত্ব থাকা দরকার।”
কথা বলতে বলতে উঠে আসে হলিউড অভিনেত্রী কর্টনি কক্স-এর প্রসঙ্গ। যিনি এক বার হলিউড তারকা জিম ক্যারির কমেডি প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে কমেডিয়ানরা নাকি মজাদার হতে পারেন না, যদি না নিজেদের জীবনে কষ্ট পেয়ে থাকেন। বোমান নিজেও কি একমত? “দেখুন পর্দায় কমেডি করা আর নিজে মজাদার মানুষ হওয়ার মধ্যে একটা তফাত রয়েছে। হাস্যরস হল এমন একটা অস্ত্র যা দিয়ে নিজেদের চারপাশের টেনশনটা কমানো যায়। আমি চ্যাপলিনের মতো কোনও দিনও কান্না লুকোনোর জন্য বলব না যে বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালবাসি। মুখ ব্যাজার করে থাকতে পছন্দ করি না। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি,” বলেন বোমান।
তেষট্টিটি ছবিতে অভিনয় করা হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা করার আগে পরিচালককে বলেছেন এক লাইনে ছবিটার সম্পর্কে বলতে। ছবির শুরুটাও এক লাইনে। শেষটাকেও এক লাইনে। পরিচালকের প্রিয় দৃশ্যটাও এক লাইনে। এগুলো পছন্দ হলে তবেই চিত্রনাট্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। ‘জলি এলএলবি’র ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। “এক লাইনে বলতে গেলে এই ছবির গল্পটা অনেকটাই বাইবেলের ডেভিড আর গোলিয়াথের কাহিনির মতো। খুব অদ্ভুুত ভাবে এক জন ক্ষুদ্র মানুষের এক জন বড় কাউকে হারিয়ে দেওয়ার গল্প। সিনেমাটা এমন একজন নিষ্কর্মাকে নিয়ে যে নাকি একজন ক্ষমতাবানের সঙ্গে লড়াই করতে যায়। ক্ষমতাবান বলতে এখানে ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। এটা শুনেই আমি পরিচালককে বলি আরও জানাতে। আমি মনে করি যে কোনও ছবিরই একটা ‘হুক লাইন’ খুবই প্রয়োজন।”
উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন ‘জলি এলএলবির কথা’। ছবিটির ট্রেলার মুক্তি পাওয়ার এক মাস পরেই ইন্টারনেটে প্রায় দশ লাখ লোক সেটা দেখে ফেলেছেন। কেউ হেসে কুটিপাটি একটা তির্যক উদ্ধৃতি দেখে, যেখানে বলা হয়েছে যে উকিলরা নাকি অনেক কিছুই করতে পারেন কেস জেতার জন্য। এমনকী সত্যি কথাও বলতে পারেন।
আবার কারও মনে পড়ছে চেন্নাইয়ের এক ডাক্তার দম্পতিকে। তাঁদের টিন-এজ ছেলেকে জিনিয়াস প্রমাণ করার জন্য তাঁকে দিয়ে ‘সি-সেকশন অপারেশন’ করিয়েছিলেন। “ছবিটি মজার ঠিকই। তবে প্রশ্ন করবেন যে সত্যি কি আমাদের দেশে বিচার পাওয়া যায়? না কি ভয় থেকেই যায় যে হয়তো শেষমেশ বিচার পাওয়া সম্ভব নয়? এই ভয়টাই দূর করা প্রয়োজন। দেখে ভাল লাগে যে দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের পরে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদও একটা বিচার পাওয়ার জায়গা পেয়েছে,” বোমান বলেন।
আরশাদ সহ-অভিনেতা হিসেবে কেমন? “দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত। জিজ্ঞেস করছিলেন না, কমেডিয়ান আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে কী যোগাযোগ? আরশাদ নিজের জীবনের কিছু ক্ষেত্রে বেশ সিরিয়াস,” উত্তর বোমানের।
তা আজকাল যে ছবি করার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন, তার পিছনে কারণটা কী? “বিনোদনমূলক ছবি মানেই সেটা খারাপ তা মনে করি না। যখন ট্র্যাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার সময় হঠাৎ দেখি পাশে রিকশাচালকটি আমায় দেখে বলছেন, ‘আপ কা ইয়ে পিকচার দেখকে বহত মজা আয়ে,’ আমার তখন ভাল লাগে। এই মানুষটাকে আমি ‘লেটস টক’-এর মতো একটা ছবি দেখতে বলতে পারি না। ওঁর প্রয়োজন ভরপুর বিনোদন। আমি সেটাই দেব।”
তবে তাই বলে সৃষ্টিশীলতার তাগিদেও ছবি করবেন। যেমন করেছিলেন ফারহান আখতারের ‘পজিটিভ’ বলে একটা শর্ট ফিল্মে। এডসের সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। চ্যালেঞ্জিং রোল ছিল এক জন এডস রুগির। “আজও “ওয়েল ডান আব্বা’ ছবিটির জন্য সুখ্যাতি শুনি। ভাল লাগে। অর্থনৈতিক ভাবে আমি অনেকটাই স্বাধীন। তাই সব সময় ছবি করার তাগিদ নেই। বয়স হচ্ছে। বাড়িতে সময় কাটাতে চাই। আর চাই এমন ছবি করতে যা আমার অভিনেতা সত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে,” বোমান বলেন।
একটা সময় ছিল যখন বন্ধুদের শুধুমাত্র কথা দিয়েছেন বলেই ছবি করতে রাজি হয়ে যেতেন। যেমন করেছিলেন সাজিদ খানের ‘হাউসফুল’। কারণ কথা দেওয়া ছিল যে সাজিদের পরিচালনা করা প্রথম ছবিতে তিনি অভিনয় করবেন। তবে সাজিদের ‘হিম্মৎওয়ালা’ করেননি। পঁয়তাল্লিশ দিনের ডেট হাতে ছিল না। এই ইন্ডাস্ট্রিতে বন্ধুদের না বলাটা কতটা ঝামেলার? “যাঁদের দেখে মনে হয় যে তাঁরা সত্যিই উত্তরটা নিতে পারবেন, তাঁদের আমি বলে দিই যে ‘আই অ্যাম নট উইদ দ্য স্টোরি’। ডেট আছে তবু মিথ্যে মিথ্যে ডেট নেই বলাটা আজকালকার দিনে সম্ভব নয়। ইন্ডাস্ট্রিতে কিছুই গোপন থাকে না। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে কে কোথায় যাচ্ছে সেটাও সবাই জানে। তার পর তো মোবাইলের দৌলতে সব কিছুই মনিটর করা যায়। খারাপ ব্যবহারও করতে পারি না লোকের সঙ্গে। আমি সত্যি সত্যি প্রার্থনা করি যাতে ছবি না করতে চাইলে ডেট নিয়ে যেন সমস্যাটা তৈরি হয়।”
আর যে চরিত্রগুলো নেন সেগুলোর জন্য তৈরি হতে গেলে কি আজও ঘুম ভেঙে গেলে চিন্তা হয়? একটা ব্যর্থতার ভয় থেকেই কি আজও ভাল অভিনয় করার খিদেটা তৈরি হয়? যে ভাবে তৈরি হয়েছিল ‘খোসলা কা ঘোসলা’র খুরানা চরিত্রটি। “না, সে রকম নয়। তবে আজও ভাবি প্রত্যেকটা সিনেমাই আমার কাছে প্রথম।”
তার মানে অভিনয় কি তাঁর কাছে এত দিনেও ‘কেকওয়াক’ নয়? “একেবারেই নয়। কেকওয়াক করলে তো শুধু মোটা আর অলস হয়ে যাব। অনেকেই বলেন অভিনয় হল নব্বই শতাংশ শিল্প আর দশ শতাংশ ভেতরের অনুভূতি। আমার কাছে হিসেবটা ঠিক উল্টো। শতাংশ ভেঙে বলতে পারব না। তবে শিল্পের থেকেও জরুরি হল মানবিক বোধ,” বলেই হেসে ফেলেন।
সামনে একটা তেলুগু ছবি করছেন। কারণ তিনি মনে করেন সিনেমাতে ভাষার কোনও ব্যবধান হয় না। বাংলা ছবি করবেন? “কেন নয়?” পাল্টা প্রশ্ন তাঁর। উইকিপিডিয়া বলে যে তিনি নাকি গড়গড়িয়ে বাংলা বলতে পারেন। “তেলুগু ছবি করলে বাংলা ছবি করতে আপত্তি নেই। তবে ওটা একদম বিশ্বাস করবেন না। সে তো উইকিপিডিয়া বলে আমি এবং প্রত্যেক পুরুষই নাকি সুখী বিবাহিত পুরুষ,” বলে অট্টহাসি দিয়ে ফোনটা রেখে দেন। |
|
|
|
|
|