|
|
|
|
হুল্লোড় |
বন্ধুত্বের হাওয়া বদল হয় না
ফেসবুকের যুগেও পাল্টায়নি ছোটবেলার নিখাদ বন্ধুত্ব।
সামান্য দেখাতেই বারুদ জ্বলে। লিখছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় |
বন্ধুত্বের মানেটা গত কয়েক বছরে অনেকটা বদলে গিয়েছে বলে মনে হয় আমার। অর্থাৎ ওই মানের জগতে সব কিছুতেই একটা হাওয়া বদল হয়েছে বলা যেতে পারে।
বন্ধু বললেই আজকাল কেমন যেন তার সঙ্গে আপনাআপনি ‘লিস্ট’ শব্দটা জুড়ে যায়। বলাই বাহুল্য মার্ক জুকারবার্গ এবং তাঁর প্রসূত মুখবুক-এর দৌলতে। আমাকে আমার এক অনুরাগী এক বার কিঞ্চিৎ রেগে গিয়েই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ফেসবুক কি আপনাদের জন্য কেবলই পাবলিসিটি মেশিনারি? এখানে আপনার বন্ধুদের প্রতি আপনার কোনও দায়বদ্ধতা নেই? তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলার প্রয়োজন নেই কোনও?” সবিনয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “ব্যক্তিগত ভাবে চেনা-জানার জন্য একটা বিশেষ সেতু দরকার লাগে মানুষে-মানুষে। ফেসবুক-এর পাঁচ হাজার ‘ফ্রেন্ডস’-এর সঙ্গে সেই সেতু তৈরি করব কী ভাবে? তার থেকে এই আপাত পরিচিতিই বেশ।
এই সেতু কিংবা সুতো যাই বলি, কী ভাবে তৈরি হয়? কী ভাবে তৈরি হয় বন্ধু? ফেসবুকেও কারও কারও সঙ্গে হতে পারে নিঃসন্দেহে। কফি শপে, হোয়াটসঅ্যাপ বা চ্যাট অন-এ কথা, ছবি বা গান বিনিময় করে হতে পারে ইদানীং। কিন্তু এই বন্ধুত্বের ভিতটা তৈরি হয় অনেক গভীরে।
বাবা-মার সময়ে দেখেছি বন্ধুত্বের ভিত তৈরি হত কোনও মতবাদকে ঘিরে। সেটা অতি-বাম রাজনীতিই হোক বা ফ্লাওয়ার পাওয়ার আর বাউলের মিশেল। রাজনীতির মুখোশ আমাদের সময়ে অনেকটাই ঢিলা হয়ে গিয়েছে। সে আর আজ আমাদের ভাবায় না। আমরা বাঁচি একটা মতবাদহীন সময়ে। কিন্তু তাও কী একটা যেন কিছু মানুষকে একে অন্যের সঙ্গে, অন্যদের তুলনায় বেশি বেঁধে রাখে। বন্ধুত্বের কারণ ব্যাখ্যা করা অনেকটা একটা গান কেন ভাল লাগল সেটা ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার মতো। একটা পর্যায়ের পর আর কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যায় না। কিছুটা অ্যাবস্ট্রাক্ট। এই অ্যাবস্ট্রাকশনের মধ্যেও দু’টো জিনিসকে আমার মনে হয় কারণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। এক ছেলেবেলা, (উপ্স সরি, কাউকে অফেন্ড করলাম বোধহয়!) ছোটবেলা বলা যাক। এবং দুই, যেটা অনেকাংশে সেখান থেকেই আসে সেটা হল একে অন্যকে বিচার না করা। অর্থাৎ বাঁধাধরা নিয়ম বা নীতির চোখ দিয়ে না দেখা বন্ধুদের। কী ভাবে? লেট মি এক্সপ্লেন... |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
সে দিন অনেক দিন পর আমার ছোটবেলার তিন বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে। এমনিতেই আমার ছোটবেলায় খুব বেশি বন্ধু ছিল না। আমি একটু অদ্ভুত গোছের ছিলাম। চুপচাপ মুখচোরা টাইপ। তাও কয়েক জন ছিল কাছের। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ নেই। যেমন পাশের বাড়ির ছেলে শান্তনু, আমার ক্যারম খেলার পার্টনার। কৌশিক মুখোপাধ্যায়, আমার বড় বয়সে হঠাৎ স্কুল বদল করে দোলনা ডে থেকে পাঠভবনে যাওয়ার পর আমার প্রথম বন্ধু। আসলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও একটু হাওয়া বদল হয়ে যায় তো! আবার এ রকম অনেকে আছেন যাঁদের সঙ্গে খুবই যোগাযোগ কিন্তু তারা প্রবাসী। তাই নিয়মিত দেখা হয় না। যেমন অভিষেক চৌধুরী, দিল্লিবাসী বহুজাতিক সংস্থার আধিকারিক। কিংবা সাহানা বাজপেয়ী, লন্ডন নিবাসী স্কলার এবং গায়িকাও বটে। আমার আসন্ন ছবি ‘হাওয়া বদল’-এ গানও গেয়েছেন তিনি। ওই একই গানে পুরুষ কন্ঠ দিয়েছেন যিনি, সেই সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়, দোলনার আর এক বাল্যবন্ধু অভিজিৎ দত্ত এবং তার সঙ্গে রাই সেনগুপ্তকে নিয়েই আড্ডা মারছিলাম কফি হাউসে। চিকেন অমলেট আর কফি খেতে খেতে ভাবছিলাম, আমাদের ছোটবেলা, আমাদের বড় হওয়াগুলো এমন কিছু ঘটনা, স্মৃতি, মুহূর্ত, আমাদের ঝুলিতে ভরে দেয় যে, সেই স্টক থেকে রোমন্থন করে যাওয়া যায় আজীবন। মনে পড়ছিল, হাই-স্কুল শেষ হওয়ার পর, কলেজে ভর্তির ফর্মের খোঁজে আমাদের যৌথ কলেজ স্ট্রিট অভিযান। সেই সূত্রে উত্তর কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, অন্য পুরোনো কলকাতাকেও চিনতে শেখা। মূল উদ্দেশ্য তখন গৌণ হয়ে গিয়েছিল। গরমের মধ্যে উত্তরের রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বেড়ানো। সে যেন ছিল আমাদের নিজস্ব ‘মোটরসাইকেল ডায়রিজ’, মোটর সাইকেলটা বাদ দিয়ে অবশ্যই! আমার আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ‘বান্ধবী’ ইকা মাঝে মাঝেই ঘ্যানঘ্যান করে যে আমার এই দোলনার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেই আমরা নিজেদের মধ্যে ছোটবেলার গল্পে মেতে উঠি। এবং শিগগিরিই বাংলায় শিফ্ট করে যাই। যার ফলে তার আর সেই আড্ডায় অংশ নেওয়া হয় না। (কিছুটা সেই তাগিদ থেকেই ও তাড়াতাড়ি বাংলা শেখার চেষ্টা করছে) কী করব! যে স্মৃতি আমরা রোমন্থন করি সেটা আমরা ছাড়া বাকিদের কাছে খুব উত্তেজক বা আকর্ষক নাও হতে পারে। কিন্তু সেগুলো আমাদের বন্ধুদের কাছে খুব দামি। কারণ সে ছিল আমাদের ছোটবেলা। আর তা যে বাংলাতেই কেটেছে! আর আজও সেই ঘটনাগুলো আমাদের অনাবিল হাসির সুযোগ করে দেয়। করে দেয় বিনা কারণে হেসে ওঠার সুযোগও। এটাও খুব জরুরি। একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে সহজে অনেক হাসতে পারা! প্রায় বিনা কারণেও। বলা ভাল এমন কারণে যেগুলো শুধু আমরাই জানি। এ রকমই অনেক কারণে আমাদের সমবেত হাসির আওয়াজে সে দিন সরগরম হয়ে উঠছিল বারবার আমাদের কৈশোরে খুঁজে পাওয়া কফি হাউস। |
বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো তিনটি সব চেয়ে পাগলামির মুহূর্ত |
• বাড়িতে পার্টি করার পর গাড়ি চালিয়ে বন্ধুদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা । ড্রাইভিং না জানা সত্ত্বেও।
• সপ্তর্ষি আর ওর দাদার সঙ্গে সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায় দার্জিলিং ম্যাল-এর আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো।
• ক্লাস টেন-এর ফাইনাল পরীক্ষার সাত দিন আগে একই দিনে বন্ধুরা মিলে পাঁচ-পাঁচটা সিনেমা দেখা। |
সব থেকে কাছের তিন বান্ধবী |
• ইকা: গত দু’বছর ধরে আমার বান্ধবী এবং আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু। আমি পাগলের মতো ভালবাসি ওকে। আর সম্মান করি। এত চাপমুক্ত আমি কোনও দিন থাকিনি। আমাদের মানসিক আদান প্রদান এক কথায় অতুলনীয়।
• সাহানা: ও এখনও আমার বড়বেলার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু। এক সময় প্রেম ছিল। যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু খুব সুন্দর ছিল সেই সম্পর্ক।
• আর একজনের নাম করতে পারব না। আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে আছে সে। |
ছোটবেলার সব চেয়ে প্রিয় তিন বন্ধু |
• সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ দত্ত আর রাই সেনগুপ্ত। |
|
বন্ধুদের মধ্যে বিচার না থাকার কথা বলছিলাম। সপ্তর্ষি, অভিজিৎ, রাই এরা প্রত্যেকেই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম জন অর্থনীতিবিদ, দ্বিতীয় জন সফল ব্যবসায়ী, তৃতীয় জন জনসংযোগের দুনিয়ায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। কিন্তু ছোটবেলায় তো আমরা ছিলাম সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা কিছু ছেলেমেয়ে। আমাদের পারিবারিক অবস্থার মধ্যেও বেশ ফারাক ছিল। আমাদের মনে আছে, অভিজিৎ বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে ছিল বলে আমরা অনেকেই ওকে ঈর্ষার চোখে দেখতাম। মাঝে মধ্যে সেটা আমাদের ব্যবহারেও প্রকাশ পেত। অভিজিৎ সেটা জানত। কিন্তু কোনও দিন একবারের জন্যও সেটা নিয়ে আমাদের কিছু বলেনি। শুধু নিজের বাড়ির দ্বার অবারিত করে রেখেছে। আমার নিজেকে মাঝে মধ্যে ক্ষমাপ্রার্থী মনে হয় ওর কাছে। ওকে নিয়ে ও রকম ভাবার জন্য। সপ্তর্ষিরও তাই। একটা সময় আমি প্রায় দিন-রাত ওদের বাড়িতে পড়ে থাকতাম। জেঠু-জেঠিমা আমাকে ছোটবেলা থেকে সন্তানস্নেহে দেখেছেন। আজও দেখেন। অথচ মাঝে বহু দিন বিভিন্ন কারণে যোগাযোগ রাখিনি ওর সঙ্গে। পরে দেখা হলে কখনও জিজ্ঞেস করেনি কেন? বা কখনও অভিমান করে দূরে সরিয়ে দেয়নি আমায়। রাই-এর সঙ্গে আমি স্কুলে পড়িনি। কিন্তু ছোট থেকে চিনি। আমার ছবি ‘হাওয়া বদল’-এর প্রোমোশনের কাজ ও প্রায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে আমাকে কিছু জানতে না দিয়েই। শুধু তাই নয়। আমি প্রতি মুহূর্তে বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছি। সাহানার কথা যে বললাম, ওর সঙ্গে আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছর আগে আমার শুধু বন্ধুত্ব নয়, ‘বিশেষ বন্ধুত্ব’ ছিল। সেই সম্পর্ক টেকেনি আমার কারণেই। কিন্তু তার জন্য আমাদের বন্ধুত্বটা একদিনের জন্যেও চিড় খায়নি। গত আট বছর ধরে আমি আর সাহানা ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। সাহানার স্বামী রিচার্ড আমার অত্যন্ত ভাল বন্ধু। আর আমার বান্ধবী ইকা সাহানার খুবই কাছের বান্ধবী। সত্যি বলতে আমার বন্ধুদের মধ্যে ইকা সব থেকে বেশি গল্প করতে ভালবাসে সাহানার সঙ্গে। আমরা যখনই লন্ডনে যাই, ওদের বাড়িতেই থাকি। সম্প্রতি আমি ওর জন্মদিনে ওকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে যাওয়ায় আমাকে অনেক গালাগাল দিল। কিন্তু তার মধ্যেও ছিল বন্ধুত্বের অধিকারবোধ।
লেখার শুরুতে আমার কিছু তির্যক মন্তব্য পড়ে হয়তো মনে হতে পারে আমি আধুনিকতার বিরোধী। তা কিন্তু নয়। আমরা যে এ ভাবে সংকীর্ণতা মুক্ত হয়ে বাঁচতে পারছি, তার কারণ কিন্তু আধুনিকতা। জীবনকে, পৃথিবীকে অনেক বড় করে, উদার করে দেখতে শেখা।
সম্প্রতি এক ঘরোয়া আড্ডাতে আমার বড়বেলার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, খুব সুন্দর একটা কথা বললেন। তিনি ভাবতেও পারেননি, মাত্র মধ্য তিরিশে তিনি তাঁর শিকড়ের প্রতি এমন টান অনুভব করবেন যে মুম্বইতে বিনোদন জগতের মস্ত চাকরি ছেড়ে তাঁকে চলে আসতে হবে তাঁর নিজের ঘর কলকাতায়।
পরে ভেবে মনে হয়েছে, যে শিকড়ের কথা তিনি বলেছেন, তার মধ্যে যেমন আছে স্বভূমির টান, তেমন আছে ছোটবেলার এবং বড়বেলার বন্ধুদের প্রতি টান। আজ অবশ্য আমি বললাম ছোটবেলার বন্ধুদের কথা। পরে কোনও লেখাতে আমার খুব কাছের বড়বেলার বন্ধুদের কথা বলব। ছোটবেলার হোক কী বড়বেলার, বন্ধুত্বের জন্য আসলে লাগে একটা শিকড়। একটা নাড়ির টান। সেটাই তৈরি করে দেয় ওই সেতুটা।
মেয়েদের কথা জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় তিরিশ পেরোলে ছেলেদের মধ্যে একটা ‘হাওয়া বদল’ হয়। হঠাৎ মনে হয় অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। আর তখন নিজেকে, নিজের চারপাশটাকে নতুন করে চিনতে ইচ্ছে করে।
কী ভেবেছিলাম! আর কী হয়েছি! কী কী পেয়েছি আর কী কী পাইনি। যা নেই তা নিয়ে দুঃখ করব, না কি যা আছে, তাই নিয়ে এগিয়ে যাব? এই নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইল। তবে আজ না। অন্য কোনও দিন। |
|
|
|
|
|