চা শ্রমিকেরা সেই অন্ধকারেই
০০৫ সালে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেকে-ই স্বীকার করেছিলেন উত্তরবঙ্গের চা বলয়ে যে মর্মান্তিক ঘটনা প্রবাহ চলছে তা যথাযথ ভাবে তুলে ধরা হয়নি, নজর দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার এত বছর পরও শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সে ভাবে হয়নি। তাঁরা অবহেলিত রয়েই গিয়েছেন।
চা বাগানকে ঘিরে ব্যবসার যে আবর্ত চলছে তা বুঝতে না পারলে এর কারণ এবং নিরসনের উপায় বোঝা শক্ত। তার একটা দিক অল্প সময়ের সমস্যা—শ্রমিকের মৃত্যু, বাগান বন্ধ হওয়া। ২০০২ সালের ওই সময়টা যেমন উত্তরবঙ্গে ২২টি বাগান বন্ধ ছিল। আরেকটা দীর্ঘ সময় ধরে ঘটছে। চায়ের বিপণন, তার অর্থনীতি।
এক সময় কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত বিশ্ব চায়ের বাজার শাসন করত। ১৯৭০ সালের পর থেকে এখানকার চায়ের বাজার কমতে থাকে। বিশ্ব চায়ের বাজার ফের ধরে ফেলছে চিন। কম দামে উৎকৃষ্ট চা সরবরাহ করে। যেটা ব্রিটিশদের সময় এ দেশের চায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। সে সময় চিন বাজার হারায়। দেশে বছরে ১০০ কোটি কিলো (১ হাজার মিলিয়ন কিলোগ্রাম) চা উৎপাদনের থেকে মাত্র ১৫০/২০০ মিলিয়ন কিলোগ্রাম রফতানি হচ্ছে। বাকি চায়ের জন্য দেশের বাজারের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। মুনাফা আশাজনক হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বাগান মালিকেরা তাদের মুনাফার অংশ পেতে শ্রমিকদের লাভের অংশে ভাগ বসায়। তাদের ন্যায্য পাওনা-গন্ডা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাতগুটিয়ে থাকেন।
টি এস্টেট, বড় বাগানে ‘প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট’ মেনে শ্রমিকদের বেতন, রেশন, বাড়ি, স্কুল, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হত। ১৯৯০ থেকে উত্তরবঙ্গে শুরু ক্ষুদ্র চা বাগান। সেখানে শ্রমিকদের সুবিধার বিষয় নেই। বটলিফ ফ্যাক্টরির লাইসেন্স বা অনুমোদন দেওয়া হত না। খোলা বাজারনীতি শুরু হলে বটলিফ কারখানা হতে শুরু করল। বড় বাগানগুলির বাজার নষ্ট হল। তারা প্ল্যান্টেশন অ্যাক্ট বাতিল করতে দাবি করছেন। অস্থায়ী কর্মী বাড়ছে বড় বাগানগুলিতে। যাঁরা অবসর নিচ্ছেন পাওনাগণ্ডা ঠিক মতো পাচ্ছেন না। নামে স্থায়ী কর্মী হলেও বাস্তবে চা শ্রমিকদের কাজ না করলে বেতন মেলে না। এখানে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাতা তোলার মরসুম। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুখা মরসুম। পাতা থাকে না। বাগানে কাজ থাকে না। এই সময় শ্রমিকদের আয় কমে যায়। সুখা মরসুমে আয় থাকে না বলে বাগান চালাতে মালিকেরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে চান। তা না পেলে অনেকে বাগান বন্ধ করে চলে যান। শ্রমিকদের অনাহারে কাটাতে হয়। সমস্যা মেটাতে যখন মুনাফা হয়, লভ্যাংশের টাকা মালিকদের মজুত করা উচিত।
চা বাগানগুলির পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রের আলাদা ভূমিকা রয়েছে। রাজ্যের ‘প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট’ রয়েছে। শ্রম দফতর দেখভাল করে। চা বাগানগুলি পরিদর্শন করে তারা শ্রমিকদের অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেন। শ্রমিকদের করুণ পরিস্থিতি, অনাহারে মৃত্যু হচ্ছে। নানা গণমাধ্যম, সমাজসেবী সংগঠন সরব হলে রাজ্য নজর দেয়।
তামিলনাড়ু টি বোর্ডের সঙ্গে এক বার কথা হচ্ছিল। সে বছর তারা ৬৬২ বার বাগানগুলি পরিদর্শন করে। তাতে এক একটি বাগান বছরে ৪ থেকে ৬ বার পরিদর্শন হয়। এখানে শ্রমিকদের পরিস্থিতি পরিদর্শনের সময় বাগান মালিকদের গাড়ি পাঠাতে বলা হয়। তা হলে পরিদর্শন কেমন হত তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই পরিকাঠামো-ও গড়তে হবে। দেরিতে হলেও সরকারি সাহায্য কিছুটা দেওয়া হচ্ছে। তাতে মৃত্যু হার কমেছে। ১০০ দিনের কাজের জন্য বাগানের কাজে শ্রমিকেরা উৎসাহ হারাচ্ছে বলে মালিকদের একাংশ সরব। তাঁরা চাইছেন না মরসুমে ওই প্রকল্প চালু থাকুক। তারা মজুরি দিচ্ছেন ৯০ টাকা। ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করে ১৩০ টাকা পাচ্ছেম। বাগান মালিকেরা মজুরি বাড়াতে চাইছেন না।
বাগানগুলির পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রের দায় বেশি। উৎপাদন কেমন হচ্ছে, তার মান নজরদারি করে টি বোর্ড। সেটা অর্থমন্ত্রকের অধীনে। টি বোর্ড পরিস্থিতি বিচার করে বাগানের লিজ বাতিল করতে পারে। অন্য বাগান মালিককে দিতে পারে। অথচ সেই ভূমিকা পালন করে না। ১৯৭০ সালে কিছু বাগান টি বোর্ড গ্রহণ করে। কিন্তু তারা চালাতে পারেনি। তাই ফের সেই পথে তারা হাঁটতে চায় না। শ্রমিকদের স্বার্থ তাই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।
দেশর টি বোর্ড নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করে বিশ্ব বাজারে জনপ্রিয় করতে পারছে না। শ্রীলঙ্কার টি বোর্ড ‘দিলমাহ’ নামে ব্র্যান্ড তৈরি করে প্রচার করল। তারা কদর পেল। সোভিয়েত ইউনিয়নে এ দেশ থেকে প্রচুর চা রফতানি হত। তা ভেঙে ‘কমনওয়েলথ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ হয়। তখন চায়ের কদর কমতে থাকে। ভারতীয় টি বোর্ড ‘নার্গিস’ ব্র্যান্ড করেছিল। রাজ কপূর,-নর্গিস যেখানে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সঠিক প্রচারের অভাবে ওই ব্র্যান্ড জনপ্রিয় হয়নি। এক বার কাঠমাণ্ডুতে চা খাচ্ছিলাম। ব্র্যান্ড দেখলাম ‘দিলমাহ দার্জিলিং টি’। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা দার্জিলিং চা কিনে ওই নামে বাজার ধরছে।
ব্রিটিশরা ভুটান থেকে ডুয়ার্সকে, সিকিম থেকে দার্জিলিংকে নিজেদের এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করল। উদ্দেশ্য ছিল ওই অংশ পেলে তারা চা বাগান করবে। শ্রমিকের কাজের জন্য লোক আনা হল ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় থেকে। পাহাড়ে পূর্ব নেপাল থেকে। তারা জঙ্গল কেটে বাগান তৈরি করেছিল। কয়লাখনি অঞ্চলেও কাজে লাগান হল তাদের। কয়লাখনিগুলি জাতীয় প্রকল্পের অধীনে গেলে তাদের অবস্থা ফিরল। চা বাগানের শ্রমিকেরা কিন্তু অন্ধকারেই পড়ে রইল।

লেখক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, প্রাক্তন ডিন (কলা, বাণিজ্য, আইন বিভাগ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.