ওই তল্লাট আপাত শান্ত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের ভাষায় ‘হাস্যমুখর’ সেই জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাওবাদীদের বিছিয়ে রাখা অসংখ্য ল্যান্ডমাইন। যা থেকে যে কোনও মুহূর্তে প্রাণঘাতী হামলার আশঙ্কা করছে পুলিশই।
এমনিতেই যত্রতত্র পোঁতা বহু মাইন উদ্ধার করা যায়নি। তার উপরে মাওবাদীরা ইদানীং ফের জঙ্গলমহলের নিত্য-নতুন জায়গায় ল্যান্ডমাইন বসাতে শুরু করেছে বলে স্বীকার করছেন পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। তাঁদের আশঙ্কা, সেগুলোর মাধ্যমে যৌথবাহিনী কিংবা কোনও ভিআইপি অথবা রাজনৈতিক নেতার উপরে যখন-তখন আক্রমণ হতে পারে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও সতর্ক-বার্তায় জানিয়েছে, দেশের মাওবাদী প্রভাবিত অঞ্চলে ভিআইপি-সুরক্ষার ক্ষেত্রে ল্যান্ডমাইনই সবচেয়ে বড় কাঁটা।
রাজ্যের পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসারেরা জানাচ্ছেন, ২০০৮-এর নভেম্বরে লালগড় আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে ২০১১-র নভেম্বরে কিষেণজির মৃত্যু এই তিন বছরে মাওবাদীরা জঙ্গলমহলের মাটিতে অসংখ্য ল্যান্ডমাইন পুঁতেছে। সবচেয়ে বেশি মাইন পোঁতা হয়েছে ২০০৮-এর নভেম্বর থেকে ২০০৯-এর জুনের মধ্যে, অর্থাৎ যৌথবাহিনী অভিযানে নামার আগে পর্যন্ত। কারণ, লালগড় আন্দোলনের জেরে ওই সাত মাস পশ্চিম মেদিনীপুর-পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার বিরাট অঞ্চলে পুলিশ-প্রশাসনের অস্তিত্ব কার্যত মালুম হতো না। তারই ফায়দা তুলেছিল মাওবাদীরা।
এবং সেই সব মাইনের একটা বিরাট অংশ পুলিশের নাগালের বাইরেই রয়ে গিয়েছে। প্রমাদ গুনছে প্রশাসন। রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশের (আইবি) এডিজি পদ থেকে সদ্য বদলি হওয়া বাণীব্রত বসুর কথায়, “মাওবাদী-কার্যকলাপে কিছুটা ভাটা পড়লেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বরং জঙ্গলমহলে এখন ল্যান্ডমাইনের বিপদ সবচেয়ে বেশি। গেরিলা লড়াইয়ে ভিআইপি কিংবা টহলদার বাহিনীর উপরে আক্রমণের সহজ উপায় হল ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ।” |
 |
সাল |
ল্যান্ডমাইন |
জিলেটিন স্টিক |
বিস্ফোরক |
ডিটোনেটর |
২০০৯* |
৬১ |
১৪২ |
২৩ |
৪৬ |
২০১০ |
৮৭ |
১৫৯ |
৩৬৬ |
০ |
২০১১ |
৩৯ |
৭১ |
৩৮৬ |
২৩০ |
২০১২ |
১৮ |
১৩ |
২১১.৫ |
১৪৬ |
* জুন মাস থেকে
অঙ্ক কিলোগ্রামে |
|
দু’-তিন বছর আগে তৈরি ও পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন কি গেরিলা-হানায় কার্যকর হতে পারে? পুলিশ-কর্তাদের ব্যাখ্যা: এই জাতীয় আধুনিক বোমা বা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর মেয়াদ বস্তুত অনন্ত কাল। রাজ্য পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড-সূত্রের খবর: যে সব ল্যান্ডমাইন উদ্ধার হচ্ছে, সব ক’টার সঙ্গে তিন-চার ফুট তার জোড়া। তাতে বড় তার জুড়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠালেই বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। প্রসঙ্গত, ২০০৮-এর ২ নভেম্বর শালবনিতে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে হামলার লক্ষ্যে ব্যবহৃত মাইনের সঙ্গে অন্তত আধ কিলোমিটার লম্বা তার জুড়েছিল মাওবাদীরা।
কোথায় কোন মাইন পোঁতা আছে, সেটা মাওবাদীরা মনে রাখবে কী করে?
রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহের বক্তব্য, “ওরা জঙ্গলমহলকে চেনে হাতের তালুর মতো। কোথাও হয়তো একটা গাছ দিয়ে একটা মাইনের অবস্থান চিহ্নিত। কোথাও হয়তো ল্যান্ডমার্ক একটা কালভার্ট।” আইজি জানান, জঙ্গলমহলে প্রতি মাসে মাইন উদ্ধার হচ্ছে। ২ ফেব্রুয়ারি সকালেও দু’টো পাওয়া গিয়েছে লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ির কাছে ভাকুয়ায়। সেগুলো বছরখানেকের পুরোনো। আরও অনেক মাইন উদ্ধার করা বাকি বলে আইজি নিজেই মানছেন।
কিন্তু সমস্যা হল, কোথায় কোন মাইন পোঁতা আছে, পুলিশ তা স্পষ্ট জানে না। ল্যান্ডমাইনের খোঁজে নিয়মিত তল্লাশি চলছে মূলত ‘কোর মাওবাদী অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত জায়গাগুলোয়। তার বাইরেও মাইন মিলছে। এবং অধিকাংশই ২০০৯ থেকে ২০১১-র মধ্যে তৈরি। বছরের পর বছর ঝড়-জল-শীত-তাপপ্রবাহ সহ্য করে সেগুলো কার্যকর থাকে
কী ভাবে?
আইজি-র দাবি, মাওবাদীরা ল্যান্ডমাইন তৈরির প্রযুক্তির পাশাপাশি এ-ও জানে, তা কী ভাবে পুঁতে রাখলে কয়েক বছর পরেও ব্যবহার করা যাবে। “মাথায় রাখতে হবে, অর্ণব দামের মতো আইআইটি’র ছাত্র মাওবাদী স্কোয়াডে ছিল।” মন্তব্য গঙ্গেশ্বরের। তিনি জানান, স্টিলের টিফিন কৌটো বা লোহার পাইপে বিস্ফোরক ভরে মাওবাদীরা ল্যান্ডমাইন বানায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্লাস্টিকে মোড়া থাকে, যাতে কোনও ভাবে বিস্ফোরক নষ্ট না-হয়। জলের মধ্যেও ফাটানো যায়। উদ্ধার মাইনগুলো ফাটিয়েই নষ্ট করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইজি।
এর সঙ্গে জুড়েছে নতুন ল্যান্ডমাইন। আইজি’র হিসেবে যার অনুপাত মোটামুটি ভাবে ১০%। যৌথবাহিনীর দাবি, লালগড়ের পূর্বে পূর্ণাপানির জঙ্গলে ক’দিন আগেই মাওবাদীরা এমন একটা মাইন ফাটিয়েছে। কিন্তু যে জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা কোণঠাসা বলে পুলিশ-প্রশাসনের দাবি, সেখানে তারা নতুন ল্যান্ডমাইন তৈরি করতে বা পুঁতে রাখতে পারছে কী করে?
আইজি’র ব্যাখ্যা, “লালগড় আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন মাওবাদী নেতারা স্থানীয় বহু যুবককে ল্যান্ডমাইন তৈরি, পোঁতা ও ফাটানোর তালিম দিয়েছিল। কয়েকটি মেয়েও প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। ওদের সবাইকে এখনও চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা যায়নি।
তা ছাড়া ল্যান্ডমাইন বানাতে তো
খুব কাঠখড় পোড়াতে হয় না। কেমিক্যাল সারকে মূল উপাদান করেই বানানো যায়।”
অর্থাৎ উপরে উপরে নিস্তরঙ্গ জঙ্গলমহলের মাটিতে বিস্তর বারুদ মজুত। বিপর্যয়ের জন্য শুধু
স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা। বিপর্যয় এড়ানোর উপায় কী?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাওয়াই, সন্দেহভাজন জায়গার মাটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা ছাড়া ‘শর্টকাট’ নেই। মাইন তল্লাশিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে পুলিশ-কুকুরকেও কাজে লাগাতে হবে। নন লিনিয়ার জাংশন ডিটেক্টর, মাইন সুইপার, ডিপ সার্চ মেটাল ডিটেক্টরের মতো সন্ধানী যন্ত্রের পাশাপাশি মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম সঙ্গে রাখা জরুরি। |