|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ১... |
|
কুম্ভে নাচেন জাপানি সন্ন্যাসিনী |
এ মেলা বুঝিয়ে দেয় তিতিক্ষা, বৈরাগ্য আর পুরুষের একচেটিয়া নয়! লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
সন্ন্যাসিনীরাও যে এত ভাল নাচতে পারেন, আগে জানতাম না!
এক ফালি তাঁবু, সেখানে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন দুই গেরুয়াধারিণী। পাশে ‘ডফলি’ বাজাচ্ছেন আর এক প্রৌঢ়া সন্ন্যাসিনী। গাইছেন আর এক সন্ন্যাসিনী, ‘জয় গণেশ, জয় গণেশ দেবা।’ কথাগুলি একই, কিন্তু অনুরাধা পড়োয়ালের গাওয়া পরিচিত সুর নয়। একটু অন্য রকম।
তখনই প্রৌঢ়া এক সন্ন্যাসিনী উঠে দাঁড়ালেন। তার পর মুণ্ডিতমস্তক, গেরুয়াধারিণীর গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচ। অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক মিরেলি মার্লেট সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁকেও রেহাই দিলেন না তিনি। সুন্দরী মিরেলিকে হাত বাড়িয়ে ডেকে নিলেন, তার পর তাঁকেও শামিল করে নিলেন নাচে। দু’জনের কেউ কারও ভাষা বোঝেন না, নাচের ধরনও আলাদা। সন্ন্যাসিনী হাত উপরে তুলে নাচের মুদ্রা দেখান, মিরেলি দুই হাত বাড়িয়ে ডুয়েট নাচের চেষ্টা করেন। ‘‘এঁরা তা হলে জীবনের সুখ আনন্দ বিসর্জন দিয়ে থাকেন না, বলো?’’ বেরোতে বেরোতে জিজ্ঞেস করলেন মিরেলি।
তাঁবুটা জুনা আখড়ার। শঙ্করাচার্যের তৈরি সাতটি শৈব আখড়ার মধ্যে সব চেয়ে বড় জুনা। সবচেয়ে বেশি নাগা সাধু এঁদেরই। কিন্তু হরিদ্বার কুম্ভের থেকে এই কুম্ভে নাগা সাধুর সংখ্যা অনেক কম। প্রয়াগ কুম্ভে এসে জানলাম, তাঁদের একটি সন্ন্যাসিনী আখড়াও আছে। দেড়শো মহিলা এক দিন মাথা কামিয়ে মুণ্ডনসংস্কার এবং যজ্ঞ করে সেখানে সন্ন্যাস নিলেন। সন্ন্যাসিনী আখড়ায় পুরুষের ঢোকা বারণ, অতএব হিন্দু ধর্মে আগ্রহী মিরেলিকেই গেটপাস বানানো গেল। তার পরই সন্ন্যাসিনীদের তাঁবুতে সেই নাচ!
কুম্ভমেলা এই রকমই। কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। ২১ বর্গকিমি জুড়ে তাঁবুর শহর, রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় সাধু ও সাধ্বীর ব্যানার। চন্দ্রস্বামী, বাবা রামদেব সকলেই আছেন। কিন্তু সন্ন্যাসিনীরাই বা কম কীসে? পাইলটবাবার আশ্রমে দেখা হল যোগমাতা কেইকো আইকাওয়ার সঙ্গে। গেরুয়াধারিণী এই জাপানি তনয়া শুধু সন্ন্যাসিনী নন, মহামণ্ডলেশ্বর। সন্ন্যাসীরাও তাঁর কাছে আসেন। |
|
গুজরাতের জুনাগড় থেকে এসেছেন সহজযোগিনী শ্রী শৈলজা দেবী। তিনি ‘মেডিটেশন’ শেখান, কুম্ভমেলায় সাধুদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসাশিবির চালাচ্ছেন। ‘‘সব সাধু তো আখড়ায় বা সঙ্ঘে থাকেন না। অনেকে একাকী ঘুরে বেড়ান। বড় হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই,’’ বলছিলেন সহজযোগিনী। বাঙালি সাধ্বীরাও কম যান না। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের নারী-সংগঠন ‘প্রণবকন্যা’ এ বারেই প্রথম কুম্ভে শিবির খুলেছে। “প্রায় শ’দেড়েক যাত্রীর থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে আমাদের তাঁবুতে,” বলছিলেন ব্রহ্মচারিণী দেবী। কুম্ভমেলা নিঃশব্দে জানাল, সন্ন্যাসিনীর সংখ্যাও বাড়ছে। তিতিক্ষা, বৈরাগ্য আর পুরুষের একচেটিয়া নয়।
দৃশ্য কোথায় নেই? শাহি স্নান। একের পর এক বিভিন্ন আখড়ার ‘জুলুস’ বা মিছিল। ঘোড়ার পিঠে প্রায় জনা দশেক নাগা সন্ন্যাসী। কারও হাতে উঁচু করে তুলে ধরা ধ্বজা, কারও হাতে তরবারি। এক জন নাগা অবস্থাতেই ঘোড়ার পিঠে তরোয়াল ঘোরাচ্ছেন। সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি।
মিছিলের সঙ্গে গোটা কুড়ি রথ। ট্রাক্টর এবং ছোট ছোট ম্যাটাডরের দু’ পাশে রঙিন সিল্কের চাদর ঢাকা দিয়ে তৈরি হয়েছে রথ। ওপরে রুপোলি হাওদায় বড় বড় মহান্ত বা ‘মহামণ্ডলেশ্বর’রা বসে। প্রত্যেকের মাথায় রুপোর ছত্রী। সঙ্গে ব্যানার এবং গৈরিক পতাকা নিয়ে আরও অনেক সেবক। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে একটি আখড়ার স্নান শেষ হবে, তার পর মিনিট পনেরোর ব্যবধানে আর একটি আখড়া। দু’টো আখড়ার মধ্যে স্নানের সময় নিয়ে ঠুকোঠুকি হলে সর্বনাশ! সেই প্রেস্টিজ-ফাইট মাঝে মাঝে রক্তারক্তিতে পৌঁছে যায়।
এক কুম্ভের মধ্যে যে লুকিয়ে থাকে আরও কত কুম্ভ! বিদেশি ও বিদেশিনীদের ছড়াছড়ি। মিরেলি ছিল, ছিল আর্জেন্তিনা থেকে আসা দম্পতি গুস্তাভো এবং মারিয়া ভারিয়োস। দু’ জনকে বলা গেল, আমরা কলকাতার লোকেরা আর্জেন্টিনা টিমের ভক্ত। এবং তার পরই বিপদ হল। গুস্তাভো বললেন, ‘‘জানি, আপনারা মারাদোনার ফ্যান।’’ মারিয়া: ‘‘না না, আমি জানি, তোমরা মেসিকে ভালবাসো। মেসি ওখানে গিয়েছিল, না?’’ ফুটবল নিয়ে দাম্পত্যযুদ্ধ না বাড়িয়ে বিদায় নেওয়া গেল। |
|
প্রাচীন ধারণা, কুম্ভ মানে তাঁবু, খড়ের বিছানা এবং দরিদ্র, সংস্কারাচ্ছন্ন ভারত। নতুন ধারণা? এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশ পর্যটন নিগমের ডিরেক্টর এক বাঙালি। সুদীপ সেন। তাঁর উদ্যোগে উত্তরপ্রদেশ পর্যটন এ বার বিলাসবহুল তাঁবু হোটেল চালু করেছিল। প্রতি রাতে থাকার খরচ ১৬ হাজার টাকা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুইস কটেজ, আয়ুর্বেদ থেরাপি আর মাল্টিকুইজিন ভেজিটেবল রেস্তোরাঁর তাঁবুও চোখে পড়ে এই অস্থায়ী মহানগরে। তবে কুম্ভের এই উন্নয়ন ব্রিটিশ আমল থেকে চলছে। বাংলা ১৩০০ সালে কলকাতার এক ভদ্রলোক প্রয়াগ কুম্ভ থেকে ফিরে তাঁর বইয়ে এক বৃদ্ধ সাধুর কথা লিখেছিলেন। সাধু তাঁকে সেই উনিশ শতকে বলেছিলেন, প্রথম কুম্ভে এসে তাঁকে একটু কষ্ট করে আটা জোগাড় করতে হয়েছিল। বারো বছর পর এসে দেখলেন, ভাতও পাওয়া যাচ্ছে। এখন চপ, কাটলেট, চা সবই পাওয়া যায়, বলেছিলেন সেই সাধু।
অস্থায়ী। গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে বালিয়াড়ি ছাড়া কিছু নেই, সেখানেই আলোময় এক শহর। হাসপাতাল, থানা, দমকল-অফিস, ব্যাঙ্ক থেকে পোস্ট অফিস, রেলের সংরক্ষণ কাউন্টার সবই গড়ে উঠেছে তাঁবুতে। গোটাটাই ফৌজি এলাকা। আগামী ১০ মার্চ মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাঁবুগুলিও পাট গুটোবে, নদীর ধারের অন্ধকারে একাকী রয়ে যাবে অনন্ত বালুচর। প্রয়াগের সঙ্গে হরিদ্বার কুম্ভমেলার আসল তফাত এখানেই। হরিদ্বারে আস্ত একটা শহরের সাপোর্ট সিস্টেম আছে। গঙ্গার ও পারে সন্ন্যাসীদের তাঁবুতে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন? ব্রিজ পেরিয়ে এ পারে হর কি পৌড়ি বা বিষ্ণুঘাটের দিকে চলে এলেই হল। রিকশা পেয়ে যাবেন। প্রয়াগে সেই গল্প নেই। শাহি স্নানের আগের দিন থেকে রিকশারও প্রবেশ নিষেধ। ‘‘প্রচুর হাঁটবেন, তার পর ক্লান্ত হয়ে স্নান করবেন। সেটিই মোক্ষ,’’ রসিকতা করছিলেন এক সাংবাদিক।
ধর্মীয় মোক্ষ? একেবারেই নয়। পরিচালক বিমল রায় প্রায় দশ বছর ধরে একটি প্রকল্পের পিছনে লেগেছিলেন। কালকূটের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ নিয়ে ছবি তৈরি। বিমল রায়ের তৎকালীন সহকারী গুলজারের মতে, বইয়ের মার্জিনে নিজের হাতে নোটস লিখে প্রায় আর একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন বিমলবাবু। কিন্তু ছবিটা হল না। তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ল!
বিমল রায়ের সিগারেট টানা বারণ, ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছেন। গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। এক রাতে তাঁর সহকারী দেখলেন মশারির মধ্যে সিগারেট টানছেন পরিচালক।
বারণ করতেই কড়া গলা। ধমক, ‘‘শাট আপ! গত তিন রাত ধরে সিগারেট টানি, তুমি আজকে দেখলে, তাই।” একটু বাদে শেষ টান দিয়ে, “উপন্যাসে বলরাম কেন মারা গেল, জানো? এত দিন ভাবতাম, লেখক ওঁকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। আজকাল মনে হয়, মোক্ষ মানে নিছক মুক্তি নয়। সংস্কৃতি।”
তার দিন কয়েক পরেই মারা গিয়েছিলেন ‘বন্দিনী’ ছবির পরিচালক। গুলজারের আজও মনে আছে, দিনটা ছিল মৌনী অমাবস্যা! |
|
|
|
|
|