মছলন্দপুর স্টেশনের চায়ের দোকানে আবার ফিরে এসেছে ১২ বছরের আকবর। ভাঁড়ে ভাড়ে চা ঢেলে দিচ্ছে নিত্যযাত্রীদের। “কী করব, স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। তাই ফিরে এলাম কাজে,” বলল আকবর।
উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার চণ্ডীপুরের শিশু শ্রমিক কল্যাণ বিদ্যালয়ে এক বছর বন্ধ শিক্ষকদের বেতন। বন্ধ হয়ে গিয়েছে পড়ুয়াদের ভাতা, মাসিক দেড়শো টাকাও। তাই আকবরের মতো অনেক ছেলেমেয়ে আবার ফিরে আসছে পুরনো পেশায়।
কেবল ওই স্কুলেই নয়। শিশু শ্রমিকদের জন্য রাজ্যে ৯০৮টি শিশু শ্রমিক কল্যাণ বিদ্যালয় রয়েছে। কোথাও পড়ুয়া ভাতা, শিক্ষাকর্মীদের বেতন বন্ধ তিন বছর ধরে, কোথাও পাঁচ মাস। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেন্দ্রীয় সরকার পাঠিয়ে দিয়েছে টাকা। কিন্তু টাকা পড়ে রয়েছে জেলা প্রশাসনের দফতরে। চণ্ডীপুরের শিশু প্রশিক্ষক সঞ্জীব মণ্ডল বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, রাজ্যে টাকা এসে পড়ে রয়েছে। কিন্তু কাগজপত্র তৈরি করতে ঢিলেমি করা হচ্ছে বলে আমরা তা পাচ্ছি না। কাউকে জানিয়েও কিছু হচ্ছে না।” |
অভিযোগের সত্যতা মিলেছে উত্তর ২৪ পরগনার প্রকল্প আধিকারিক (এনসিএলপি) প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের কথাতেই। তিনি বলেন, “টাকা এসেছে। কিছু দিনের মধ্যে সবাই পেয়ে যাবেন।” কিন্তু এক বছর ধরে সেই টাকা দেওয়া হচ্ছে না কেন, তার উত্তরে প্রদীপবাবুর যুক্তি, “কাগজপত্র ঠিকঠাক করে সব কাজকর্ম করতে দেরি হয়েছে।” জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, “টাকা এলেও কেন পড়ে রয়েছে তা দেখা হচ্ছে।” আর তিন বছর ধরে টাকা না পাওয়ার প্রসঙ্গে বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, “এই প্রকল্পের জন্য আমাদের জেলার আরও কিছু তথ্য কেন্দ্র চেয়েছিল। সেই তথ্য পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই সমস্যা মিটে যাবে।”
শিশু শ্রমিকরা যাতে স্কুলছুট না হয়, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী থেকে শ্রমমন্ত্রী সবার কাছে
বারবার স্মারকলিপি দিয়েছেন শিক্ষাকর্মীরা। কোনও সুরাহা হয়নি। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু সোমবার বলেন, “আজকেই বিষয়টি নজরে এসেছে। কেন ভাতা বা বেতনের
টাকা মিলছে না তা নিয়ে শীঘ্রই
সমস্ত জেলাশাসকদের সঙ্গে
আলোচনা করব।”
পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ১২ লক্ষ শিশু নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতে কাজ করছে, বলছে ইউনিসেফ-এর তথ্য। শিশুশ্রমিকদের সংখ্যার নিরিখে দেশে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ষষ্ঠ। শ্রম দফতরের স্কুলগুলি তাদের বড় জোর পাঁচ শতাংশকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়। সেই সামান্য সুযোগটিও এই শিশুরা হারাচ্ছে কেবলমাত্র ‘ব্যস্ত’ আধিকারিকদের উদাসীনতার জন্য। যদিও ১৯৯৫ সাল থেকে কেবল এই শিশুদের জন্যই নিযুক্ত রয়েছেন সেই আধিকারিকরা। ইটভাটা, চায়ের দোকান, পরিচারিকার মতো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত-থাকা ছেলেমেয়েদের শিশু শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্পের (এন সি এল পি) স্কুলগুলিতে পড়ার কথা।
এক-একটি স্কুলে গড়ে ৫০ জনের মতো ছাত্র এবং ৫ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হন। ছাত্রদের বর্তমানে মাসে ১৫০ টাকা, শিক্ষাকর্মীরা দুই থেকে চার হাজার টাকা পান। রাজ্য শ্রম দফতর এই প্রকল্পের দায়িত্বে। তবে কেন্দ্র থেকে এই টাকা সরাসরি চলে যায় সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের কাছে। নিয়ম হল, প্রতি মাসে সেই টাকা পোস্টঅফিস বা ব্যাঙ্ক মারফত চলে যাবে প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু স্রেফ ঢিলেমির কারণে এই ক’টা টাকাও সময়মতো পাচ্ছেন না ছাত্র-শিক্ষাকর্মীরা। গাফিলতির শীর্ষে বীরভূম। সেখানে তিন বছর মেলেনি ভাতা-বেতন। তার পর যথাক্রমে নদিয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, দুই দিনাজপুর ও মালদহ।
এই ঢিলেমির মাসুল দিতে হচ্ছে বাদুড়িয়া থানার চণ্ডীপুর পঞ্চায়েতের বেনা গ্রামের ১১ বছরের সাদ্দাম হোসেন, ১০ বছরের সালেমা খাতুনের মতো ছেলেমেয়েকে। অভাবের কারণেই দর্জির দোকানে কাজ করত সাদ্দাম, মায়ের সঙ্গে মাঠে কাজ করত সালেমা। কাজ বন্ধ করে স্কুলে আসছে তারা। কিন্তু ক’দিন পারবে? “পাশের গ্রাম দাসপাড়ার বর্ষা চৌধুরীর বাড়ির লোক ওর পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। বর্ষা এখন ঝুড়ি বুনছে,” বলল ওরা। যেমন চা বানাচ্ছে আকবর।
পড়াশোনা চালাতে পারবে কি সাদ্দাম, সালেমারা?
|