২০০০ সালে যখন ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির গোড়াপত্তন হয়, তখন সকলের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এ বার একটা পরিকাঠামো তৈরি করা গেল যেটা ভারতীয় ক্রিকেটের দরকারগুলো নিয়ে ভাববে।
জাতীয় দলের সাপ্লাই লাইন দেবে এনসিএ, এমনই ভাবা হয়েছিল। যেখানে গোটা দেশ থেকে তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা জড়ো হবে তাদের ক্রিকেটীয় এবং শারীরিক স্কিল ঝালিয়ে নিতে। যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তাদের মানসিক ভাবে তৈরি করা হবে। প্রায় তেরো বছর পর এনসিএ কি এই লক্ষ্যে সফল হয়েছে? খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছি না।
অনেক ক্ষেত্রেই এনসিএ এখন ক্রিকেটারদের রিহ্যাব সেন্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিজেও এই তালিকায় পড়ি বলে বলছি, অ্যাকাডেমির এই দিকটা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ক্রিকেট শিবির হবে আর বাকি সময় জাতীয় দলের চোট পাওয়া ক্রিকেটাররা বিশ্বমানের ফিজিও আর ট্রেনারদের সাহায্য নিতে আসবেএনসিএ-কে কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে হবে।
কয়েক দিন আগেই এনসিএ-তে একটা শিবির হল। গত বারের রঞ্জিতে যে পেসাররা ভাল করেছে, তাদের জন্য। তরুণ পেসারদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে দারুণ সুযোগ। কিন্তু এই পেসাররা নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পরে এনসিএ ওদের জন্য কী করছে, সেটাই আসল। মনে আছে পাঁচ বছর আগে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে ভারত যখন অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতল, তন্ময় শ্রীবাস্তব নামে এক বাঁ-হাতি ওপেনার খুব প্রশংসা পেয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে খুব তাড়াতাড়ি ও জাতীয় দলে বাছাই হওয়ার তালিকায় ঢুকে যাবে। কিন্তু সে এখন কোথায়? উত্তরপ্রদেশের হয়ে এখনও রঞ্জি খেলছে, কিন্তু জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার কাছাকাছি আসতে পারেনি। ওর উন্নতির উপর কি আদৌ নজর রাখা হয়েছিল? মনে হয় না।
|
এক বছরেরও কম সময় আগে অস্ট্রেলিয়ায় আবার অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতল ভারত। তখন তারকা হিসেবে অধিনায়ক উন্মুক্ত চন্দ ছাড়াও নাম উঠে এসেছিল পঞ্জাবের পেসার সন্দীপ শর্মা এবং মুম্বইয়ের বাঁ-হাতি স্পিনার হরমীত সিংহের। ওদের উন্নতির উপরও কি নজর রাখা হচ্ছে? মরসুমের শুরুতে হরমীত ইরানি ট্রফি ম্যাচে খেলেছিল কিন্তু এখন মুম্বই রঞ্জি দলের জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিকল্প হিসেবেও ওকে ভাবা হয় না। সন্দীপ বেশ ভালই খেলছে। কিন্তু নির্বাচক বা ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকেরা যেমন চেয়েছিলেন, উন্মুক্ত সে ভাবে উন্নতি করতে পারেনি।
এরা সবাই তরুণ ক্রিকেটার। বয়স ১৯ বা তার চেয়ে সামান্য বেশি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি ১৯ থেকে ২২এই সময়টা তরুণ ক্রিকেটারের শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। উন্মুক্ত, সন্দীপ, হরমীতদের যে প্রতিভা আছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। ওদের এমন একটা পরিবেশ দিতে হবে যেখানে ওরা উন্নতি করতে পারবে। সেটা করা হয়ে গেলে নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা পুরোপুরি ক্রিকেটারদের উপর ছেড়ে দেওয়া দরকার। এটা করলেই বোঝা যাবে, সর্বোচ্চ স্তরের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা কার কার মধ্যে আছে।
এই ক্রিকেটারদের যাতে তুলোয় মুড়ে না রাখা হয়, সেটার দিকে কড়া নজর রাখা দরকার। এনসিএ-র কোচ বা সাপোর্ট স্টাফ যথেষ্ট যোগ্য। তারা পারবে তরুণদের ঠিকঠাক নির্ভরতা দিতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটাররা এতটাই স্বনির্ভর হয়ে যায় যে ফিজিও ছাড়া বাকি সাপোর্ট স্টাফের দরকার পড়ে না। এনসিএ-তে যথেষ্ট সময় কাটালে, ঠিকঠাক ট্রেনিং পেলে কিন্তু এটা সম্ভব।
আমি যখন ল্যাঙ্কাশায়ারে খেলতাম তখন আমার সতীর্থদের মধ্যে সাজিদ মাহমুদ নামের এক তরুণ পেসার ছিল। ওকে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড ভবিষ্যতের জন্য লগ্নি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আর তাই সাজিদের উন্নতির খবরাখবর নিতে আমার কাউন্টির সঙ্গে ইসিবি নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। ও কী ভাবে ট্রেনিং করছে, কতটা কাজের চাপ নিচ্ছেএ সব ছাড়াও মরসুমে তিন-চার বার এক জন মনোবিদ পাঠাত ওর মানসিক উন্নতি ঠিকঠাক রাখতে। ব্যাপারটা দেখে আমার চোখ খুলে গিয়েছিল। ভাবতে বসেছিলাম, আমরাই বা কেন এ ভাবে এগোব না?
আমার মনে হয় ভারতীয় ক্রিকেটকে এনসিএ-র আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। ওখানকার কোচ, ফিজিও, ট্রেনার, গোটা পরিকাঠামো যে খুব ভাল সেটা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। এ রকম দারুণ একটা সেন্টার থাকা সত্ত্বেও সেটাকে পুরো কাজে লাগানো হচ্ছে নাএর চেয়ে বড় হতাশা আর কী হতে পারে? এনসিএ-র কোচেদের আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া উচিত। জাতীয় দলের সাপ্লাই লাইন ঠিকঠাক তৈরি করতে গেলে এনসিএ-র কোচেদের সঙ্গে রাজ্য দলগুলোর কোচেদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি যাতে শুধু রিহ্যাব সেন্টার হয়েই না থেকে যায়, সেটা আটকানোর এটাই প্রথম ধাপ।
|