ভেবে দেখলে মৃত্যু কি যথার্থই কোনও শাস্তি? মৃত্যু তো এক ধরনের মুক্তি। অপরাধীর অনুতপ্ত
হওয়ার অবকাশ কই! পৃথিবীর অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ড তুলে দিয়েছে। ‘যাবজ্জীবন’ বলতে
প্রকৃত অর্থে সারা জীবন কারাদণ্ড, সেই পথ অনুসরণ করা শ্রেয়।
কৃষ্ণা বসু |
আফজল গুরুর ফাঁসিকাঠে মৃত্যু হঠাৎ করে মনে পড়িয়ে দিল আমার পার্লামেন্টারি জীবনের এক ভয়াবহ ও ঐতিহাসিক দিনের কথা, ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সে দিন পার্লামেন্ট আক্রমণ করেছিল পাঁচ পাকিস্তানি জঙ্গি। পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হয়েই মুলতুবি হয়ে যায়, যেমন প্রায়ই ঘটে থাকে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিলাম গাড়ির অপেক্ষায়। তার মিনিট দুয়েক বাদেই অ্যানেক্স ভবনে নিজের বিদেশ দফতরের অফিসঘরে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম সিঁড়িতে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেইখানে পড়ে আছে প্রথম জঙ্গির মৃতদেহ। টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার চলছে বাকি চার জনের সঙ্গে আমাদের সুরক্ষাবাহিনীর সংঘাতের। বেলা তিনটে অবধি সকলেই বন্দি ছিলাম পার্লামেন্ট চত্বরে। পরে কমান্ডোরা বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
আফজলের ফাঁসির সংবাদ প্রকাশ হওয়া মাত্র এক নিরন্তর আলোচনা প্রবহমান: কাজটা ঠিক হল কি না, এত দিন পরে কেন এই দণ্ড, কেন গোপনীয়তা, এই দণ্ডদানের বিলম্ব অথবা এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তের পিছনে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও অভিসন্ধি ছিল কি ছিল না, ইত্যাদি। এই প্রবল আলোচনার স্রোতে সে দিনের ভয়াবহ পরিপ্রেক্ষিত এবং এই ঘটনার যে গুরুতর পরিণতি হতে পারত, তা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। |
প্রতিবাদ। জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট-এর চেয়ারম্যান ইয়াসিন মালিক
(মাঝখানে) ও অন্যরা। ইসলামাবাদ, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি: এ এফ পি
|
আমরা যেন ভুলে না যাই যে, সে দিনের পার্লামেন্ট আক্রমণ ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর বিরাট আঘাত। ভাল ভাবে ছক কষে পাকিস্তানি জঙ্গিরা এর পরিকল্পনা করেছিল। এই ধরনের পরিকল্পনা কার্যকর করতে স্থানীয় মানুষের সাহায্য লাগে। কখনও জেনে-বুঝে, কখনও বা না-জেনে স্থানীয় মানুষ এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। মুম্বই সন্ত্রাসের সময় আমরা জেনেছি কুখ্যাত হেডলি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁর প্রকৃত পরিচয় ধরতে পারেননি। এ কথা সত্য, সে দিনের আক্রমণকারী জঙ্গিদের মধ্যে আফজল গুরু ছিলেন না। তিনি এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলানি পরে ধরা পড়েন। তাঁরা ষড়যন্ত্রী হিসেবে গ্রেফতার হন। অধ্যাপক গিলানি ছাড়া পেয়ে যান। আফজল গুরু বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন। আজমল কসাবের ক্ষেত্রে যেমন অকাট্য প্রমাণ ছিল, ছবি, ফুটেজ ইত্যাদি, গুরুর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। আদালত নির্ভর করেছেন পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর।
সে দিন যদি এক জন জঙ্গিও পার্লামেন্টের ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হত, ফল হত ভয়ানক। নিরাপত্তা রক্ষীরা তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে বড় রকমের অঘটন বাঁচাতে পেরেছিলেন। তাঁদের হাতে অস্ত্র ছিল না, ছিল শুধু ওয়াকি-টকি। তাঁরা পরস্পরকে বিপদসঙ্কেত দিতে পেরেছিলেন। আহত অবস্থায় ভবনের বিশাল দরজা বন্ধ করেছিলেন। নয় জন রক্ষীর প্রাণ গিয়েছিল।
ঘটনার সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিণতি অবশ্য হয়েছিল এই যে, ভারত পাকিস্তান প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। ভারত সরকার বলেছিল, তোমাদের জঙ্গিদের মৃতদেহ তোমরা নিয়ে যাও। পাকিস্তান বলল, আগে প্রমাণ করো ওরা পাকিস্তানি। এমনই চাপান-উতোরের মধ্যে সীমান্তে দু’দেশের সেনাবাহিনী সাজো সাজো রবে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
ভারত পাকিস্তান দু’দেশেরই আছে পরমাণু অস্ত্র। পৃথিবীর সব দেশে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক। ইংল্যান্ড আমেরিকা তাদের কূটনীতিকদের পরিবারবর্গকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। নির্দেশিকা জারি করা হল, ভারতীয় উপমহাদেশে যেন কেউ এই সময়ে না যায়। অবস্থা স্বাভাবিক হতে বহু দিন লেগেছিল।
আফজল গুরু সম্পর্কে যে কোনও আলোচনায় এই পশ্চাৎপট ও পরবর্তী বিপজ্জনক পরিস্থিতি স্মরণে রাখা উচিত।
ভারতের তরফে অবশ্য পর দিন থেকেই অবস্থা স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। আমরা পর দিন স্বাভাবিক ভাবে পার্লামেন্টের অধিবেশন করেছিলাম। আমার বিদেশ মন্ত্রক কমিটিতে আফগানিস্তানে সদ্য-নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সতীন্দ্র লাম্বা সেখানকার পরিস্থিতির উপর বক্তব্য পেশ করলেন। তবুও, ভারত শান্তিপ্রিয়, দায়িত্বশীল দেশ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এ কথা ব্যাখ্যা করতে ভারতীয় কূটনীতিকদের ইউরোপ আমেরিকা দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছিল।
আফজল গুরুর দণ্ডাদেশ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। কাশ্মীর উপত্যকার পরিস্থিতি মাথায় রাখতে হয়। গুরু বলেছিল সে নির্দোষ, তাকে মিথ্যে জড়ানো হয়েছে, রাষ্ট্রীয় রাইফেলস্-এর প্রতি অভিযোগ ছিল। এমন ঘটনা যে কাশ্মীরে ঘটে না, তা নয়। মানবাধিকার আইনজ্ঞ জলিল আন্দ্রাবিকে শ্রীনগরের পথে নিজের গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘মিসিং’ হয়ে যান তিনি। তার পর ঝিলম নদীতে তাঁর বস্তাবন্দি মৃতদেহ ভেসে ওঠে। আমি পার্লামেন্টে প্রশ্ন তুলেছিলাম, ভাসা ভাসা জবাব পাই। আশ্চর্য হয়ে গত বছর খবর কাগজে পড়লাম, আমেরিকাতে নিজের পরিবারকে খুন করে এক ভারতীয় ধরা পড়েছে। তদন্তে প্রকাশ সে রাষ্ট্রীয় রাইফেলস্-এর এবং আন্দ্রাবির গ্রেফতার ও খুনের জন্য দায়ী। খবর ছিল, সরকার তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তি দিতে চায়। আফজলের ঘটনা অবশ্য একেবারে ভিন্ন। তদন্ত, চার্জ গঠন, নিম্ন আদালত, দিল্লি হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, সব আইনসম্মত ভাবে হয়েছে। সহবন্দি গিলানি মুক্তি পেয়েছেন। অপর বন্দি শওকত দশ বছর জেল খেটে ছাড়া পেয়েছেন। আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ড কিন্তু বহাল রেখেছে আমাদের বিচারব্যবস্থা। আইনের দিক থেকে এর পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে বলার কিছু থাকে না। বিচারক অবশ্যই নির্ভর করেন পুলিশের দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ দলিল-দস্তাবেজের উপর। সেখানে কোনও ত্রুটি থাকবে না এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। তবুও বিচারব্যবস্থার যথাযথ পদক্ষেপ সবই গুরুর ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে। এর পর তাঁর স্ত্রী তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কালামের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। এই আবেদন ঝুলে ছিল এত কাল।
প্রশ্ন উঠেছে, তড়িঘড়ি এই আবেদন নামঞ্জুর করার ফলে লাভ, ক্ষতি কী হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কী বলেন জেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতি তাঁর সিদ্ধান্ত নেবেন, এ বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থায় কাশ্মীর উপত্যকায় এর প্রভাব কী রকম পড়বে তা চিন্তার বিষয়। অনেক দিন ধরে কাশ্মীরের মানুষ এক গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগছেন। নিঃসন্দেহে তা অধিকতর হবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর সঙ্গে তার স্ত্রী-পুত্রের শেষ সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া নিষ্ঠুর, অমানবিক। এর জন্য ক্ষোভ আরও বেশি হবে। গোপনীয়তা বজায় রেখেও শেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা যেত। খুবই দুর্ভাগ্যজনক হল এই যে, পার্লামেন্ট আক্রমণের মতো গুরুতর অপরাধে সাব্যস্ত অপরাধী মৃত্যুদণ্ডের ফলে শহিদের মর্যাদা পেয়ে বসবে, যেমন পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে ফাঁসি-যাওয়া মকবুল বাট। দু’জনেরই দেহ শায়িত আছে তিহাড় জেলে। এর চেয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের পক্ষে কম ক্ষতিকর হত। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কী করা উচিত, ভারতকে এখন ভাবতে হবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মৃত্যুদণ্ড অপরাধ বন্ধ করে না। এক জন জঙ্গির ফাঁসি হলে আর জঙ্গি হানা হবে না এমন নয়। মানবাধিকার কর্মীরা বলেন মৃত্যুদণ্ড খুনের বদলে খুন, অতএব অমানবিক। ভেবে দেখলে মৃত্যু কি যথার্থই কোনও শাস্তি? মৃত্যু তো এক ধরনের মুক্তি। সব পাপ-পুণ্য দুষ্কৃতি-সুকৃতির ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। অপরাধীর অনুতপ্ত হওয়ার অবকাশ কই! পৃথিবীর অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ড তুলে দিয়েছে। ‘যাবজ্জীবন’ বলতে প্রকৃত অর্থে সারা জীবন কারাদণ্ড, সেই পথ অনুসরণ করা শ্রেয়। ঝুলে থাকা আরও সব বিতর্কিত আবেদন নিয়ে আর যেন সমস্যায় পড়তে না হয়। |