নেতারা উদ্বোধন করিতে ভালবাসেন, তাহা সর্বজনবিদিত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই ভালবাসাকে প্রযুক্তির মিশেলে ভিন্ন স্তরে লইয়া গিয়াছেন। এখন আর উদ্বোধন করিবার জন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোনও একটি উৎসবের মঞ্চ হইতে তিনি ‘রিমোট কন্ট্রোল’-এ উদ্বোধন করিয়া থাকেন। দার্জিলিং উৎসবে তিনি ম্যালে বসিয়াই বিজনবাড়ি সেতুর উদ্বোধন করিয়াছিলেন। পানাগড়ের মাটি উৎসবের মঞ্চ হইতে তিনি দুর্গাপুর-বাঁকুড়া হাইওয়ের উপর নির্মিত ওভারব্রিজ উদ্বোধন করিয়া দিয়াছেন। বিপণন পরিভাষায় ইহাকে ‘একটি কিনিলে একটি বিনামূল্যে’ প্রকল্প বলা যাইতে পারে উৎসবের সহিত ‘বিনামূল্যে’ উদ্বোধন। সমস্যা হইল, প্রযুক্তি বা বিপণন, কোনও যুক্তিই অন্যদের মন গলাইতে পারিতেছে না। বিজনবাড়ি সেতুর ফের উদ্বোধন হইয়াছিল, কারণ গোর্খা পার্বত্য পরিষদ তাহাদের অধিকারসীমায় মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ মানিতে রাজি হয় নাই। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলিয়াছেন, তিনি দুর্গাপুর-বাঁকুড়া হাইওয়ের ওভারব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করিবেন। কেন? কারণ এই ওভারব্রিজটি ভারতীয় রেল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত। সরকারি বিধি এবং স্বাভাবিক সৌজন্য, কোনওটিই রেলকে অন্ধকারে রাখিয়া মুখ্যমন্ত্রীর ‘রিমোট কন্ট্রোল’-এ উদ্বোধন সারিয়া ফেলাকে সমর্থন করে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধি বা শিষ্টাচারের তোয়াক্কা করেন নাই। তাঁহার পারিষদরা এই অসৌজন্যকেই ‘স্বাভাবিক’ প্রতিপন্ন করিতে কুযুক্তির অবতারণা করিতেছেন। রেল প্রতিমন্ত্রীর রাগ হইলে তাঁহাকে দোষ দেওয়া যাইবে না।
অধীর চৌধুরীর সহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সম্পর্কটি মধুর নহে। কিন্তু তাঁহাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখিয়া রেলসেতুর উদ্বোধন সারিয়া ফেলিবার ঘটনাটিকে সেই রাজনৈতিক শৈত্য দিয়া ব্যাখ্যা করিলে অতিসরলীকরণ হইবে। এই উদ্বোধন-রহস্যের বীজ রহিয়াছে মুখ্যমন্ত্রীর মনোভূমিতে। তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন দেখা গিয়াছে পশ্চিমবঙ্গে রেলের প্রকল্পের উদ্বোধন তিনি একাই সারিয়া ফেলিতেছেন স্থানীয় সাংসদ বা বিধায়ক তাঁহার বিরোধী দলের সদস্য হইলে তাঁহাদের নিমন্ত্রণমাত্র জোটে নাই। এখন রেল ‘বিরোধী পক্ষের’ হাতে, কাজেই তিনি তাঁহার উদ্বোধনী কার্যক্রম হইতে রেলমন্ত্রককে ছাঁটিয়া ফেলিয়াছেন। অর্থাৎ, কোন প্রকল্প কাহার, কোন আচরণ শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত আর কোনটি নহে, এই প্রশ্নগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্পর্শ করে না। তিনি জানেন, তিনিই সব। তিনি থাকিতে আর কাহারও কিছু করিবার নাই। তাঁহার দলের নেতারা এই অলিখিত নিয়মটি এমন অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলেন যে মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত এই নিয়মের অসম্ভাব্যতা লইয়া ভাবিবার অবকাশই পান নাই। ফলে, দলের সভায় জনতা নিয়ন্ত্রণের কাজেও তিনি, স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধজন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে শিশুদের সামলাইতেও তিনি, বাসভাড়া না বাড়াইতেও তিনি, তৃণমূল সমর্থকদের কলেজ-গুণ্ডামির ব্যাখ্যাতেও তিনি। সন্দেহ হয়, তাঁহার দুনিয়ায় তিনি খুব ভয়ানক রকম একা। |