ছোট্ট রওশন আলিকে নিজের লিভারের অংশ দান করে নতুন জীবন দিয়েছিলেন তার বাবা। আর রবীন্দ্র জসোরিয়ার প্রাণ বাঁচালেন তাঁর মেয়ে, ২১ বছরের মোহিনী। আপাতত বাবা-মেয়ে দু’জনেই সুস্থ। লিভার প্রতিস্থাপনের মতো জটিল অস্ত্রোপচার কলকাতাতেও যে সম্ভব, সে কথা ফের প্রমাণিত হওয়ার খবর যে রাজ্যবাসীর কাছে স্বস্তির, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে পথ চলা শুরু করে বেসরকারি হাসপাতাল যখন তরতরিয়ে এগোচ্ছে, তখন সরকারি হাসপাতালের এমন মুখ থুবড়ে পড়ার দশা কেন, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
ছ’বছর আগে এসএসকেএম হাসপাতালে রাজ্যের প্রথম লিভার প্রতিস্থাপনটি হয়েছিল। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত আরও দু’টি প্রতিস্থাপন হয়েছে সেখানে। একটি সফল। অন্যটি সফল হয়নি। বাইপাসের এক হাসপাতালে দু’টি প্রতিস্থাপন হয়েছে। আরও দুই রোগী অপেক্ষায় রয়েছেন। যেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের অস্ত্রোপচারে খরচ হয় সাত লক্ষ টাকা, বেসরকারিতে খরচ পড়ে ২২ লক্ষ টাকা।
বি কম ফাইনাল বর্ষের ছাত্রী মোহিনীর বাড়ি বর্ধমানে। বাবা রবীন্দ্র জসোরিয়ার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। মোহিনীর কথায়, “অনেকেই অন্য রাজ্যে যেতে বললেও বাবার ভরসা ছিল কলকাতার উপরেই। শেষে কলকাতার ডাক্তারেরাই নতুন জীবন দিলেন।” |
মেয়ে মোহিনীর সঙ্গে রবীন্দ্র জসোরিয়া।—নিজস্ব চিত্র |
চিকিৎসক মহেশ গোয়েন্কা এবং ইন্দ্রজিৎ তিওয়ারির নেতৃত্বে ২০ জন চিকিৎসকের একটি দল ওই অস্ত্রোপচারটি করেছিলেন। মহেশ গোয়েন্কা বলেন, “অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা থাকা সত্ত্বেও লিভার প্রতিস্থাপনে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষ ভরসা করে এগিয়ে না এলে রাজ্যের চিকিৎসকদের পক্ষে নিজেদের প্রমাণ করা কঠিন।” রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে ভরসা দিতে ওই হাসপাতালগোষ্ঠীর দিল্লি হাসপাতাল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন চিকিৎসক সুভাষ গুপ্ত। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তিনি নিজে আটশোরও বেশি লিভার প্রতিস্থাপন করেছেন। সুভাষবাবুর বক্তব্য, কলকাতার চিকিৎসকেরা কোনও অংশে কম নন।
কম যে নন, তা ছ’বছর আগে রওশন আলির সফল অস্ত্রোপচার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তার প্রচারও হয়েছিল। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা যে আর সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকবে না, সে কথা ঘোষণাও করেছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বছর দুয়েক আগে আর একটি মাত্র লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছে এসএসকেএমে। সাত বছরের অনিমেষ বাগদি সুস্থ হয়েছে তার মায়ের দান করা লিভারে। কিন্তু তার পর থেকে আর কোনও প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা পর্যন্ত হয়নি। অথচ রাজ্যে অবিলম্বে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন এমন রোগীর সংখ্যা কয়েক হাজার।
কেন আর কাজ এগোলো না এসএসকেএমে? হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকেরা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “লিভার প্রতিস্থাপন নিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতি না তৈরি হলে এগোনো সমস্যা।”
কিন্তু যাঁরা চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারবেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও কাজ এগোচ্ছে না কেন? সরকারি হাসপাতালে যে অস্ত্রোপচার সাত লক্ষ টাকায় সম্ভব, সেটাই তো তাঁদের তিন গুণ বেশি খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে করাতে হচ্ছে। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, রোগীর পরিবার খরচ বহনে সক্ষম হলে অস্ত্রোপচারে কোনও অসুবিধা নেই। যদিও এসএসকেএমের হেপাটোলজি বিভাগ সূত্রের খবর, তেমন রোগীদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্তাদের কী বক্তব্য? প্রতিস্থাপন যে হচ্ছে না, সেই খবরটাই নেই তাঁদের কাছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “না হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেন থমকে আছে, খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।”
|