নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
অপরাধ জগতে একটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি ৩০ হাজার টাকায় বিকোয়। মাওবাদীরা কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তা কেনে ৪৫ হাজার টাকায়।
বাজারে পাঁচ হাজার টাকায় যে-ছোট আগ্নেয়াস্ত্র মেলে, তার জন্য মাওবাদীরা অনায়াসে দিয়ে দিচ্ছে তিন গুণ দাম অর্থাৎ ১৫ হাজার টাকা।
শনিবার রাতে চাঁদনি চক এলাকায় এক অস্ত্র ব্যবসায়ী, তার ভাই এবং এক শাগরেদকে গ্রেফতার করার পরে অস্ত্রের জন্য মাওবাদীদের এই জলের মতো টাকা খরচের বিষয়টি জানতে পেরেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)।
পুলিশ জানায়, ধৃত অস্ত্র ব্যবসায়ীর নাম বিল্লু। তার ভাইয়ের নাম বালা এবং শাগরেদের নাম আলিবাবা। বিল্লু ও বালা হাওড়ার বাগনানের বাসিন্দা। জেরায় মাওবাদীদের জন্য অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করেছে বিল্লু। তার স্বীকারোক্তি থেকেই ওই অস্ত্র চক্রের কথা জেনেছে এসটিএফ। ওই চক্রের হদিস পেতে কলকাতা পুলিশকে সাহায্য করেছে ঝাড়খণ্ডের সিআরপি-ও। ধৃতদের জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, পশ্চিমবঙ্গের চোরাই অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে অস্ত্র, বুলেট ও বোমা কিনছে ঝাড়খণ্ডের মতো ভিন্ রাজ্যের মাওবাদীরা। বেশি দাম দেওয়ায় অস্ত্রের জোগানে কোনও ঘাটতিও হচ্ছে না। মাওবাদীরা অবাধেই কলকাতা এবং মহানগরীর উপকণ্ঠে এসে মারণাস্ত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ওই তালিকায় একে-৪৭ রাইফেলের মতো আধুনিক অস্ত্রও আছে। |
ধৃত অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং তার দুই সঙ্গী। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র। |
কে এই বিল্লু? এসটিএফ জানায়, বাগনানের একটি চক্র অন্তত চার বছর ধরে ঝাড়খণ্ডের মাওবাদীদের আগ্নেয়াস্ত্র, বুলেট এবং আইইডি সরবরাহ করছে। বিল্লু সেই চক্রেরই পাণ্ডা। তদন্তকারীরা জেনেছেন, বাগনানের কারখানায় আইইডি তৈরি হত। মুঙ্গের থেকে কখনও গোটা আগ্নেয়াস্ত্র, কখনও বা অস্ত্রের বিভিন্ন অংশ এনে জোড়া দেওয়া হত কারখানায়। চক্রটি মেটিয়াবুরুজ, আসানসোলেও সক্রিয়। শনিবার রাতে চাঁদনি চকে বিল্লুদের ভাড়া-বাড়িতে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং আইইডি তৈরির সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। ওই বাড়িতে তারা বেশ কয়েক বছর ধরে বসবাস করছিল। ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের ছোট নাগপুর জোনের ‘মিলিটারি উইং’-এর প্রধান প্রসাদ ওরফে কৃষ্ণ আয়ারের হয়ে কাজ করত বিল্লু।
গোয়েন্দাদের জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছে, মাস তিনেক আগে প্রসাদের সঙ্গে বিল্লুর চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী তিনটি আইইডি এবং ১০ হাজার বুলেট ঝাড়খণ্ডের মাওবাদীদের সরবরাহের বরাত পেয়েছিল চক্রটি। ইতিমধ্যে ঝাড়খণ্ডের এক মাওবাদী এসে হাওড়া থেকে একটি আইইডি নিয়েও গিয়েছে। এই দফায় বরাত অনুযায়ী বাকি দু’টি আইইডি এবং বুলেট সরবরাহ করা হয়েছিল কি না, গোয়েন্দারা নিশ্চিত নন। এসটিএফ জানতে পেরেছে, বিহার থেকে ঝাড়খণ্ডে যাতায়াত করা সুবিধাজনক। সেই কারণে পুলিশি নজরদারি বেশি। তাই পুলিশের চোখে ধুলো দিতে অস্ত্র পাচারকারীরা বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গকেই।
পুলিশ জানায়, অস্ত্র পাচার করতে গিয়ে আগেও অন্তত দু’বার গ্রেফতার হয়েছিল বিল্লু। ২০০৭-এ ধরা পড়েছিল হাওড়ায়। ২০১০ সালে মাওবাদীদের জন্য অস্ত্র পাচার করতে গিয়ে ঝাড়খণ্ডে ফের ধরা পড়ে সে। ওই রাজ্যের বারিয়াতুর থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন ও ঝাড়খণ্ডের নিজস্ব মাওবাদী দমন আইনে মামলা রুজু হয়। জেলে থাকাকালীন মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয় বিল্লুর। দ্বিতীয় বার গ্রেফতারের প্রায় সাত মাস পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে বিল্লু ফের পুরোদমে পশ্চিমবঙ্গে বসে মাওবাদীদের আগ্নেয়াস্ত্র, আইইডি সরবরাহের কাজ করছিল এবং মাঝেমধ্যে রাঁচির অদূরে এক জঙ্গলে প্রসাদের সঙ্গে দেখাও করে আসছিল বলে জেনেছেন তদন্তকারীরা।
কিন্তু মাওবাদীরা অস্ত্রের বাড়তি দাম কেন দিচ্ছে? কী ভাবে দিচ্ছে?
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “টাকার অভাব নেই বলেই যে ঝাড়খণ্ডের মাওবাদীরা অস্ত্রের জন্য বেশি দাম দিতে পারছে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। বেশি দাম দেওয়ার কারণ মোটামুটি দু’টো।
১) ঝাড়খণ্ডে অস্ত্র ও বুলেট জোগাড় করতে মাওবাদীদের সমস্যা হচ্ছে।
২) বিহারের মুঙ্গের থেকেও তারা সরাসরি অস্ত্র আনতে পারছে না।
তাই দ্বিগুণ বা তিন গুণ দাম দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চোরাই অস্ত্র কারবারিদের কাছ থেকে সেগুলো জোগাড় করছে তারা।” তবে একে-৪৭ এবং বুলেট কী ভাবে এই রাজ্য থেকে ঝাড়খণ্ডের মাওবাদীদের হাতে গেল, সেটাই সব চেয়ে উদ্বেগ ও অনুসন্ধানের বিষয় বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে মধ্য কলকাতায় মাওবাদীদের টেকনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড আর্মস ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট (ট্রাম)-এর প্রধান সদানালা রামকৃষ্ণকে গ্রেফতার করে এসটিএফ। তাঁকে গ্রেফতারের পরে জানা যায়, বাংলা থেকে রকেট-লঞ্চারের যন্ত্রাংশ ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আবার ২০১০ সালের জুনে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে বুলেট-বোঝাই একটি গাড়ি ধরা পড়ে। বিহার থেকে আসা ওই বুলেট জঙ্গলমহলের মাওবাদীদের কাছে পাঠানো হচ্ছিল বলে এসটিএফের গোয়েন্দারা জানতে পারেন। |