প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
সেতু তুমি কার? যিনি আগে উদ্বোধন করবেন, তাঁর!
দুর্গাপুর-বাঁকুড়া হাইওয়েতে রেললাইনের উপর নতুন ওভারব্রিজের এখন তেমনটাই দশা। শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাটি উৎসবে গিয়ে এর উদ্বোধন করে ফেলেছেন। রেলের মন্ত্রীসান্ত্রী, কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। অথচ রাজ্য সরকারের সঙ্গে রেলও ওই সেতু তৈরির জন্য টাকা দিয়েছিল। তাঁদের কেউ টের পাওয়ার আগেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছে “ওভারব্রিজ উদ্বোধন হল।” হতবাক রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী এখন বলছেন, এই ভাবে উদ্বোধন হয় না। তিনি ফের সেতুর উদ্বোধন করবেন।
এক দিকে বর্ধমান, অন্য দিকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরের একাংশ। তার পরে ওড়িশা-সহ গোটা দক্ষিণ ভারত। দুর্গাপুর স্টেশনের কাছেই এই সেতু তৈরি তাই গোটা রাজ্যের জন্যই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ দিকে সেতু তৈরির কাজও প্রায় শেষ। তাই ভোটের আগে সেতুর উদ্বোধন করে কৃতিত্ব নিতে চাইছিল কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সব পক্ষই। দিল্লিতে বসে রেল প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে একপ্রস্ত পরামর্শও সেরে রেখেছিলেন স্থানীয় সিপিএম সাংসদ শেখ সইদুল হক। কিন্তু তাঁদের টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন মমতা। অন্য কেউ কিছু করে ওঠার আগেই তিনি ওই সেতুতে নিজের সিলমোহর বসিয়ে ফেলেছেন। শনিবার মাটি উৎসব উদ্বোধন করতে পানাগড়ে গিয়েছিলেন মমতা। রিমোট কন্ট্রোলে সেখানেই উদ্বোধন করেন সেতুর। স্থানীয় সাংসদ তো দূরের কথা, রেলের অফিসাররাও কিছু টের পাননি।
কেন জানানো হল না রেলের কাউকে? পানাগড় থেকে ফিরে রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সকৌতুক জবাব, “ওঁরা খবরের কাগজ পড়ে জেনে নেবেন।” মুখ্যমন্ত্রী যে এই ভাবে তাঁদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবেন, তা ভাবতেও পারেননি অধীর-সইদুলরা। অধীরবাবু বলছেন, “এ তো মহা মুশকিল! খাবার খেতে দেখছি জোর করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে।” আর সইদুল সাহেবের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে মনে হচ্ছে, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল।
আর কী বলব!” দু’জনেরই বক্তব্য, ওই প্রকল্প উদ্বোধন করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই মুখ্যমন্ত্রী এমন
কাণ্ড করেছেন। |
কিন্তু যে প্রকল্পে রাজ্য সরকারের পাশাপাশি রেল মন্ত্রকও টাকা দিয়েছে, উদ্যোগী হয়েছিলেন স্থানীয় সাংসদ-বিধায়করাও, আমন্ত্রণ করা তো দূর, তাঁদের একেবারে না জানিয়েই তার উদ্বোধন করায় প্রশ্ন উঠছে মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যের অভাব নিয়েও।
দুর্গাপুর-বাঁকুড়া হাইওয়েতে ওই সেতুর কাজ শুরু হয় বামফ্রন্টের জমানায়, ২০০৭ সালে। ঠিক হয়, লাইনের উপরের অংশের কাজ করবে রেল। দু’দিক থেকে সেতুতে ওঠার রাস্তা তৈরি করবে রাজ্যের পূর্ত দফতর। সেই অনুযায়ী দুই তরফই খরচ বহন করেছে। শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। কিন্তু সেতুর উদ্বোধন যখন হল, তখন রেলমন্ত্রী পবন বনশল ও রেল প্রতিমন্ত্রী দু’জনেই রইলেন অন্ধকারে। কংগ্রেস ও সিপিএম শিবিরের মিলিত অভিযোগ, মমতার এমন অভ্যাস নতুন নয়। রেলমন্ত্রী থাকার সময়ও তিনি রেলের অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদ-বিধায়কদের ডাকতেন না, তাঁরা সিপিএমের হলে। রেলের বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। তা-ও থাকত না। সর্বত্র একাই স্বমহিমায় বিরাজ করছেন মমতা। রেল ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার পরেও দীর্ঘ সময় রেল মন্ত্রক ছিল তৃণমূলেরই দখলে। তখনও রেলের সমস্ত প্রকল্প মুখ্যমন্ত্রীই উদ্বোধন করতেন। কিন্তু এখন যখন রেল মন্ত্রক কংগ্রেসের দখলে, তখন সেই ধারা অব্যাহত।
অধীরবাবুর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা রাজ্যের জন্য কিছুই করতে পারছেন না। তাই অন্যের কৃতিত্বে ভাগ বসাতে চাইছেন। তিনি বলেন, “এখনও মুখ্যমন্ত্রী ভুলতে পারছেন না যে তিনি আর রেলমন্ত্রী নন। পশ্চিমবঙ্গে রেল ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। রেলটাও কেন্দ্রের সম্পত্তি। তাই তিনি মাটিকে ঘাঁটি করেছেন।” অধীরের কটাক্ষ মমতার মাটি উৎসবের দিকে। |
এ-তো মহা মুশকিল! খাবার খেতে
দেখছি জোর করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে।
অধীর চৌধুরী
|
এ বার ইচ্ছে হলে কুড়ি বার উদ্বোধন করুন।
লোকে দেখবে আর হাসবে।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়
|
|
কিন্তু এখন কী করবেন? অধীরের বক্তব্য, “এ ভাবে হয় না কি? দুর্গাপুরে গিয়ে সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে হবে তো! সেটা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।” তৃণমূল নেতারা অবশ্য এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছেন না। সুব্রতবাবুর জবাব, “এক বার উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে। এ বার ইচ্ছে হলে কুড়ি বার উদ্বোধন করুন। লোকে দেখবে আর হাসবে।” উদ্বোধন নিয়ে এই কাজিয়ার মধ্যেই লোকে অবশ্য হাসছে, অন্য কারণে। যে রেল গেট দিনে ১৩৪ বার বন্ধ হত, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে অন্যতম প্রধান যোগাযোগকারী ৯ নম্বর রাজ্য সড়কে লেগে থাকত যানজট, মুক্তি মিলেছে তা থেকে। সেতু দিয়ে চলছে গাড়ি। নীচে অবাধে ছুটছে দিল্লিগামী ট্রেন।
ফলে উদ্বোধনের দই যে-ই নিক না কেন, মানুষ খুশি সেতুবন্ধনে। |
সহ-প্রতিবেদন: সুব্রত সীট
ছবি: বিশ্বনাথ মশান |