তোলা-রাজে অমিল রাস্তার ঠিকাদার
বিস্তর রাস্তা তৈরি হবে। পাহাড়প্রমাণ টাকাও মজুত। অথচ কাজ করার লোক মিলছে না। তোলাবাজির ভয়ে বরাত নিতে চাইছেন না ঠিকাদারেরা। তাঁরা বলছেন, লাভের গুড় যদি তোলাবাজই খেয়ে যায়, কাজ করব কেন?
সুতরাং গ্রামে-গঞ্জে সড়ক নির্মাণের বহু প্রকল্প কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। জেলায় জেলায় আরও অন্তত ছ’হাজার কিলোমিটার বাড়তি রাস্তা তৈরির কথা। এ জন্য দিল্লি থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা এসেছে। পঞ্চায়েত দফতর কাজের বরাত দিতে ই-টেন্ডার ডেকেছিল। সাড়া মিলেছে নামমাত্র। ঠিকাদারদের বড় অংশের অভিযোগ: বহুমুখী তোলাবাজির বাড়বাড়ন্তে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠেছে, তাই রাজ্যে কাজ করতে আর তাঁরা উৎসাহ পাচ্ছেন না। এবং এ প্রসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আঙুল উঠেছে শাসকদলের ‘আশ্রয়পুষ্ট’ তোলাবাজদের দিকে।
বেশ কিছু ঠিকাদারের অভিজ্ঞতায় এরই প্রতিফলন। যেমন পূর্ব মেদিনীপুরে কাঁথির নন্দীআরিয়া-কচুরি, কিংবা পটাশপুরের সিংদা মোড়-রামচন্দ্রপুর সড়ক প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনায় পাকা রাস্তা দু’টো তৈরির বরাত পেয়েছিল দুই ঠিকাদার সংস্থা। তাদের অভিযোগ, প্রথম দিনই এক দল লোক এসে হুমকি দিয়ে বলে, রফা ছাড়া কাজ হবে না। ঠিকাদারেরা জেলা পরিষদে নালিশ জানিয়েও ফল পায়নি। বেশ কিছু দিন পরে জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে কাজ চালু হয় বটে, তবে সে জন্য ‘বোঝাপড়া’ করে নিতে হয়েছে।

বরাতে বিরাগ
জেলা দরপত্র সাড়া
হাওড়া ৭০
কোচবিহার ৪০
মালদহ ৫০
নদিয়া
পশ্চিম মেদিনীপুর ২৫০ ১২
পূর্ব মেদিনীপুর ৩৫
নদিয়ায় এক ঠিকাদারেরও একই অভিজ্ঞতা। মোহনপুর বাজার থেকে আনন্দপুর পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তার বরাত নিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ, কাজ শুরু হতেই কয়েক জন এসে মোটা চাঁদার দাবি তোলে। তার বহর শুনে ঠিকাদার সেই যে পাততাড়ি গুটিয়েছেন, আর ফেরেননি। রাস্তাও হয়নি। বিবিধ অভিযোগের মধ্যে এ দু’টো নমুনা মাত্র। প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনার কাজে যুক্ত রাজ্য ঠিকাদার সংগঠনের কর্তা ক্ষেমেন্দ্রকুমার মজুমদারের কথায়, “কাজ করতে নামলেই দলে দলে এসে চাঁদা চাইছে! অনেকের আবার দাবি, পুকুরপাড় বাঁধিয়ে দিতে হবে, এমনকী গোয়ালে ইট পাততে হবে! এত আবদার মিটিয়ে হাতে থাকবে কী?” ঠিকাদার সংগঠন-সূত্রের খবর, আগেও নানা কাজে তোলা দিতে হতো। কিন্তু এখন তা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এক কোটি টাকার কাজে ১ থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ‘খুচরো’ চাঁদার দাবি উঠছে। তা-ও এক জনকে নয়, একাধিক জনকে দিতে হচ্ছে। খাস পঞ্চায়েত দফতরের খবর: নানা নামে, নানা রূপে এ হেন তোলাবাজির রমরমায় বিভিন্ন পথ-প্রকল্প থমকে গিয়েছে। যেমন বর্ধমানের কেতুগ্রামে, বাঁকুড়ার বড়জোড়া ও রানিবাঁধে, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে, বীরভূমের নানুর ও ইলামবাজারে। একই কারণে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ, হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনায় অজস্র রাস্তা তৈরি বন্ধ গিয়েছে।
এই সব তিক্ত অভিজ্ঞতার জেরেই এখন পথ-বরাত থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন ঠিকাদারেরা। “এ তো শুধু হিমশৈলের চূড়া! এখন যে কোনও কাজের জন্য একাধিক জায়গায় প্রণামী দেওয়া দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।” আক্ষেপ এক ঠিকাদারের। ওঁদের অনীহার পরিণামে রাজ্যে গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণের প্রকল্পটাই মাঠে মারা যেতে বসেছে বলে পঞ্চায়েত-কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা। এক কর্তা বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তার কাজ শুরু করা। ঠিকাদার না-পাওয়ায় পরিকল্পনা বানচাল হওয়ার জোগাড়।” কী রকম?
দফতরের তথ্য: পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি আরও ৬১৪৩ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক তৈরির অনুমোদন দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। সেই খাতে দিল্লি ৩৪৯০ কোটি টাকা পঞ্চায়েত দফতরে পাঠিয়েছে, যা দিয়ে মোট ১৪২৫টি রাস্তা হওয়ার কথা। কিন্তু ই-টেন্ডারে ৮৭৪টি রাস্তার বরাত নিতে একটাও আবেদন জমা পড়েনি! ১০৬টি রাস্তা বানাতে একটি করে সংস্থা দরপত্র ছেড়েছে। ৪৬টি রাস্তায় আগ্রহী সংস্থার সংখ্যা দু’টি করে। অর্থ দফতরের নিয়ম মোতাবেক, ন্যূনতম তিনটি ঠিকাদার সংস্থা আবেদন না-করলে দরপত্র বাতিল হয়ে যাবে। সেই মাপকাঠি পেরিয়েছে ৩৭৫টি প্রকল্প। যেগুলো রূপায়িত হলে সাকুল্যে ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে, খরচ হবে ৯০০ কোটি। অর্থাৎ রাস্তা নির্মাণ ও বরাদ্দ খরচ, দু’ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছেও পৌঁছানো যাবে না।
ক’টি রাস্তায় ঠিকাদার নেই
পশ্চিম মেদিনীপুর ২৩৮
পুরুলিয়া ১০০
হাওড়া ৭০
উত্তর দিনাজপুর ৬৫
বাঁকুড়া ৫০
দক্ষিণ ২৪ পরগনা ৩০
বরাত নিতে এই ‘অনাগ্রহ’কে সরকার কী ভাবে ব্যাখ্যা করছে?
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গ্রামোন্নয়ন সংস্থার অন্যতম কর্তা সত্যব্রত চক্রবর্তী বলেন, “প্রতি কিলোমিটার কাজের জন্য ৫৭ লক্ষ টাকা খরচ ধরা আছে। তার পরেও ঠিকাদারেরা রাজি হচ্ছেন না! এটা বিস্ময়কর। খোঁজ-খবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে ওঁদের ডেকে আলোচনা হবে।” কিন্তু ঠিকাদারদের একাংশ যে তোলাবাজির অভিযোগ তুলছেন?
এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই বলে সত্যব্রতবাবুর দাবি। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য অভিযোগটি সরাসরি নস্যাৎ করার পাশাপাশি এর পিছনে রাজনৈতিক চক্রান্তেরও গন্ধ পাচ্ছেন। বলছেন, “তোলাবাজির কথা একেবারে ভিত্তিহীন। যা বুঝতে পারছি, এখানে সিপিএম জড়িত। ওরাই পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামে পাকা রাস্তার কাজ বানচাল করতে চাইছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনা নয়, কোনও কাজেই ঠিকাদার আসছে না।” সঙ্কট মোকাবিলার উপায়ও মন্ত্রী ভেবে রেখেছেন। “সরকারি সংস্থাকে দিয়ে কাজ করাব। দরকারে বেকার ছেলেদের ঠিকাদারি লাইসেন্স দেব। সিপিএমের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে।’’ মন্তব্য সুব্রতবাবুর। তাঁর অভিযোগ, “ওরা চৌত্রিশ বছরে যত কিলোমিটার রাস্তা করেছে, আমি এক বছরে তার বেশি রাস্তা শুরু করেছি। তাই সিপিএমের সহ্য হচ্ছে না।” সুব্রতবাবুর অভিযোগ মানতে চাননি বাম জমানার পঞ্চায়েত প্রতিমন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ। নদিয়ায় মোহনপুর বাজারের রাস্তাটি তাঁরই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বঙ্কিমবাবু বলেন, “তোলাবাজির কারণে আমার এলাকাতেই রাস্তা হয়নি। আরও উদাহরণ দেখাতে পারি। সারা রাজ্যে একই পরিস্থিতি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.