|
|
|
|
ত্রিপুরার সুরে যেন মমতার ছায়া |
জমি কিনেই শিল্প, ফিরলে
গতি বাড়াবেন মানিক
সন্দীপন চক্রবর্তী • আগরতলা |
|
|
খানিকটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, খানিকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দুই পথ মিলিয়েই রাজ্যে শিল্প আনার রাস্তায় এগোতে চান মানিক সরকার। চতুর্থ বারের জন্য সরকারে ফিরতে পারলে কর্মসংস্থানের সমস্যা সমাধানে শিল্পের লক্ষ্যেই পদক্ষেপ করার নকশা ছকে ফেলেছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী।
উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও ত্রিপুরার শিল্প-পরিস্থিতি মোটেও বলার মতো নয়। এই মুহূর্তে দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানেন, তাঁরা চাইলেই এই ছোট্ট রাজ্যে বড় শিল্প রাতারাতি চলে আসবে না। শুরু করতে হবে ছোট ও মাঝারি শিল্প দিয়ে। সাম্প্রতিক কালে রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার থেকেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ পরিষেবা গড়ে তুলে পরিকাঠামো নির্মাণে। ক্ষমতায় ফিরলে এ বার সেই পরিকাঠামোর উপরে ভিত্তি করেই শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় গতি আনতে চান মানিকবাবু। আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, “৫-৭-১০ বছর আগে তো বলিনি। এখন শিল্পের কথা বলছি। সরকার তো শিল্প করতে পারে না। শিল্প গড়বে বেসরকারি পুঁজি। যদি তারা দেখে পরিকাঠামোই নেই, তা হলে কে শিল্প গড়তে আসবে? শিল্প করার জন্য পরিকাঠামো এক সময় ছিলই না। এখনও রেল, আকাশ, টেলি-যোগাযোগ আমাদের আকাঙ্ক্ষা মতো সবটা হয়ে গিয়েছে, তা নয়। কিন্তু এগোনোর পরিস্থিতি এসেছে।”
তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে শিল্পায়নের দিকেই এগোনোর লক্ষ্য নেওয়া যদি বুদ্ধবাবুর মতো হয়, তা হলে মমতার ধারা অনুসরণও আছে পরের পর্বে। মানিকবাবু চান, বেসরকারি শিল্পপতিরা রাজ্যের শিল্প-তালুকে প্রকল্প করুন। তার বাইরে করতে চাইলে জমি কিনে নিন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “শিল্পনীতির ক্ষেত্রে পরিষ্কার করে দিয়েছি। শিল্প-তালুক থেকে জমি নিয়ে শিল্প করতে পারেন। পয়সা দিয়ে নেবেন। বিনা পয়সায় কাউকে জমি দেব না।” সরকারের ভূমিকা? মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “আমাদের কাছে এলে ভূমি রাজস্ব দফতর বুঝতে সাহায্য করবে মালিকানা, জমি ঠিক আছে কি না। দরদাম তিনি ঠিক করবেন, আমরা নয়।” বিনিয়োগকারীর পছন্দ-করা জমি সরকারি হলে দেখা হবে সেখানে অদূর ভবিষ্যতে সরকারের কোনও পরিকল্পনা আছে কি না। সব দিক যাচাই করে রাজ্যের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বিচার করে সেই জমির জন্য সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হবে বিনিয়োগকারীকে। মানিকবাবুর কথায়, “এটাই আমাদের নীতি।”
ত্রিপুরা শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পবিত্র কর জানাচ্ছেন, রাজ্যের ৮টি জেলাতেই তাঁরা জাতীয় সড়কের ধারে শিল্প-তালুক গড়ার চেষ্টা করছেন। তার জন্য সরকারি জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে উর্বর কৃষিজমি এবং ঘন বসতি বাদ দিয়ে। ক্ষতিপূরণও থাকবে পর্যাপ্ত। ত্রিপুরা সিপিএমের বক্তব্যেই পরিষ্কার, পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধবাবুর জমানার মতো তাড়াহুড়ো করে হাত পোড়াতে তারা রাজি নয়। বুদ্ধবাবু অবশ্য ইদানীং বলছেন, ক্ষমতায় ফিরলে ‘সতর্ক’ হয়ে তাঁরা শিল্পায়ন করবেন। কিন্তু লগ্নিকারীরা জমি কিনে নিতে গেলে তো দালালের খপ্পরে পড়বেন? যা নিয়ে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে সরব বঙ্গ সিপিএম। মানিকবাবুর বক্তব্য, “ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না। দু’একটা জায়গায় যে নেই, তা বলতে পারব না। তবে সেটা (দালাল-রাজ) বড় সমস্যা নয়।” ত্রিপুরা সিপিএমের ‘নিরুপম সেন’ পবিত্রবাবুর কথায়, “স্থানীয় পঞ্চায়েত, তহসিল, জেলাশাসকের দফতরকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি।”
আগরতলার কাছে যে খয়েরপুর কেন্দ্র থেকে পবিত্রবাবু প্রার্থী, তার মধ্যেই রয়েছে এ রাজ্যের সব চেয়ে বড় শিল্প-তালুক বোধজংনগর। জমি রয়েছে ৭৫০ একর। তালুকের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের রাস্তা, ১৩২ কেভি-র বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, প্রাকৃতিক গ্যাসের ‘ফিডস্টক’, জলের যোগান তৈরি। বর্ধমান থেকে আধুনিক রাইস মিল বা তামিলনাড়ু থেকে রাবার ইউনিটের জন্য জমি কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। আগরতলাতেই ডুকলি বা অন্য জেলায় ধর্মনগর, উদয়পুর, কুমারঘাটে হয়েছে শিল্প-তালুক। বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে অনেকটা জমি যে তালুকে ব্যবস্থা হওয়া রাতারাতি সম্ভব নয়, সরকার জানে। তবে যত দিন না বড় শিল্পের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, ছোট ও মাঝারি দিয়েই এগোতে চায় ত্রিপুরা। মানিকবাবুর কথায়, “কৃষিতে সাফল্য এসেছে। বিদ্যুৎ আসছে। রাজ্য ছোট হলেও একটা বাজার তৈরি হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এখানে এলে লাগোয়া যে অঞ্চল, সেখানকার বাজারও ধরতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা।”
পালাটানায় ৭২৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ত্রিপুরা সরকারের উৎসাহ বাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসকে ব্যবহার করে সার উৎপাদন কেন্দ্র গড়ার জন্য রাজ্য কথা বলেছে ওএনজিসি-র সঙ্গে, যারা প্রস্তাব দিয়েছে টাটাকে। সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ উন্নত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে চাপ রেখে চলেছেন মানিকবাবুরা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সরকার-জনগণ একসঙ্গে লড়াই করে একটা জায়গায় এনেছি। এর সঙ্গে চাইছি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। চট্টগ্রাম, আশুগঞ্জ বন্দরের সুযোগ নিতে চাইছি। এগুলো সব করতে পারলে উত্তর-পূর্ব ভারতের গেটওয়ে-তে পরিণত হবে ত্রিপুরা। তখন ভারত সরকারের ‘লুক ইস্ট পলিসি’র জন্য কাজে আসবে।” কী ভাবছে বিরোধীরা? রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা সমীররঞ্জন বর্মণের মতে, “কুড়ি বছরে বামফ্রন্ট রাজ্যটাকে একশো বছর পিছিয়ে দিয়েছে! তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক থাকলে শিল্পের জন্য জমি এখানে কোনও সমস্যা নয়। আমরা ক্ষমতায় এলে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে সরকারি ভূমিকা থাকবে কি না, প্রকল্প দেখে ঠিক করব।” ছোট হলেও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম চায় না ত্রিপুরা! বাণিজ্যে নীতি পুবে তাকাও। রাজনীতিতে পশ্চিমে তাকাও এবং শিক্ষা নাও! |
|
|
|
|
|