পুণ্যার্থীদের প্রাণ কাড়ল পুণ্যের ভিড়ই, স্নান সাড়ে তিন কোটির
ফজল গুরুর ফাঁসির প্রতিক্রিয়া নয়, সন্ত্রাস নয়। মহাকুম্ভে মৌনী অমাবস্যার শাহীস্নানে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে এল আদি অকৃত্রিম ভিড়ের চাপ। সঙ্গমস্থলেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন দু’জন। তার পর সন্ধেবেলায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা অপেক্ষা করে রইল ইলাহাবাদ জংশনে। ভিড়ের চাপে ওভারব্রিজ ভেঙে প্রাণ হারালেন অন্তত ১০ জন বেশি পুণ্যার্থী।
রেকর্ড ভিড় এ বার, সাড়ে তিন কোটি। এই সাড়ে তিন কোটির মধ্যে এক দিকে রয়েছেন অনিল অম্বানী ও তাঁর মা কোকিলাবেন। রয়েছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা দর্শনার্থীরা। সবচেয়ে বড় অংশটি বিহার-পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশের গ্রামগঞ্জ থেকে ঝেঁটিয়ে আসা দেহাতি মানুষ। শনিবার দুপুর ২টো ২৮ থেকে রবিবার ১২টা ৪৭ অবধি মৌনী অমাবস্যার মহালগ্নে এঁরা সকলেই প্রয়াগের সঙ্গমে স্নান করলেন।
পুণ্যস্নানের আনন্দের মেয়াদ অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক আহতকে। ইলাহাবাদ স্টেশনে প্রশান্ত মল্লিকের তোলা ছবি।
সন্ধে সাতটা নাগাদ ইলাহাবাদ জংশনে তখন প্রায় লাখ দু’য়েক মানুষের ভিড়। পটনা যাওয়ার একটা ট্রেন দেওয়া হয়েছে খবর পাওয়ামাত্র দলে দলে সকলে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটছিলেন। সে সময় ওভারব্রিজ দিয়ে বিপরীত মুখে আসছিল আরও একটি দল। এই দু’দলের মধ্যে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। একটি সূত্রের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করেছিল। কোনও কোনও প্রত্যক্ষদর্শীও সে রকমই দাবি করেছেন। কিন্তু পুলিশের তরফে বলা হচ্ছে, লাঠি চলেনি। যাত্রীদের একটা লাইনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল পুলিশ। কিন্তু সব মিলিয়ে ফল হয় মারাত্মক। মানুষের চাপে ওভারব্রিজের একটা দিকের রেলিং ভেঙে যায়। সটান নীচে পড়ে যান যাত্রীরা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই পুণ্যভূমের রেলস্টেশন মৃত্যুভূমে পরিণত হল। সারি সারি শোয়ানো রয়েছে ‘বডি’। দিশাহারা মানুষের কান্না। স্ট্রেচারে সার সার আহতদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে।
ক’ঘণ্টা আগেও এই মানুষগুলোই সস্তা ছিটের জামা-প্যান্ট, মাথায় বোঁচকা নিয়ে ভীতু চোখে পরস্পরের আঁচল বা জামা ধরে এগিয়ে চলছিল। কখনও রাস্তায় লাইন বেঁধে, কখনও পনেরো জন মিলে ব্যাগবোঁচকা-সহ ভ্যান রিক্সা বা অটোয়। হরিয়ানার এক গ্রাম থেকে ট্রাকে করে ৩০ জনের একটি দল এসেছিল। থাকার জায়গা নেই, ট্রাকেই খড় বিছিয়ে শুয়েছিল তারা। কেউ শুয়েছে সঙ্গমের তীরে, বালিয়াড়িতে। কেউ দারাগঞ্জ ব্রিজের নীচে। হারিয়ে গেলে ‘ভুলেভটকে’ শিবিরের মাইকে কেঁদে ফেলেছে।
সঙ্গমের উদ্দেশে। পুণ্যস্নানের দিন কুম্ভমেলায় উৎসবের মেজাজে সাধুরা। রবিবার। ছবি: এএফপি
‘ভুলেভটকে’ শব্দটা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় এখানে। এঁদের কেউ হারিয়ে গেলে পুলিশ তাকে সেখানে জমা করে দেয়। তারপর শুধু ‘বেগুসরাই জেলার ধনিয়া, তোমার মা এই শিবিরে অপেক্ষা করছেন’ বলে ছেড়ে দেওয়া হয় না। ধনিয়ার মায়ের হাতেও মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি দেহাতি টানে ‘আরে ধনিয়া, ম্যায় খো গ্যয়ি’ বলে হু হু করে কেঁদে ফেলেন। কথা শেষ হয় না। মৌনী অমাবস্যার ভিড়ে এ রকম কত ঘোষণাই যে কানে এল! এক বার বাংলাও শুনলাম, ‘ও লক্ষ্মীদি, আমি কেষ্টপুর গ্রাম থেকে তোমার সঙ্গে এসেছিলাম’ এবং তার পরই কান্না! অথচ দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র থেকে বৃহত্তম ধর্মীয় শো, এই ভীতু মানুষগুলিই টিকিয়ে রাখে।
এঁদের নিরাপত্তার জন্যই আজ চিন্তিত ছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। আফজল গুরুর ফাঁসির পর শনিবার থেকেই প্রয়াগের আকাশে চক্কর মারছিল হেলিকপ্টার। শনিবার রাতে বড় বড় সন্ন্যাসীরাও টেনশনে ছিলেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসী অস্ফুটে বলছিলেন, ‘‘ফাঁসিটা আজই দিল! কিছু হবে না, বলুন?’’ কিছু হয়ওনি। শনিবার রাত বারোটায় দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বর্ধমান, চিত্তরঞ্জন থেকে আসা ভারত সেবাশ্রমের সাতশো স্বেচ্ছাসেবী গঙ্গায় পজিশন নিলেন। সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে রাত একটায় লাইন দিয়ে স্নান করতে এলেন যাত্রীরা। তাঁদের স্নান করানো থেকে গঙ্গার ঘাট পরিষ্কার সবই রবিবার দুপুর অবধি অক্লেশে করে গেলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আখড়ার বড় বড় মোহান্তরা রবিবার সকালে নাগা সাধুদের সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে, শিবিকায় স্নান করতে এলেন। ব্যারিকেডের দু’পাশে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সন্ত্রাসে নয়, মৃত্যু এই জনস্রোতে থাবা বসায় জনস্রোতের নিজেরই পায়ের চাপে। কালকূট ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ লিখেছিলেন ’৫৪ সালের কুম্ভকে নিয়ে। সে বারও ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল শ্যামার বর, লক্ষ্মীদাসীর স্বামী বলরাম। তখন সাড়ে তিন কোটির ভিড় হত না। আজ মেলার সেক্টর ১২ এলাকায় বারাণসী থেকে আসা এক মহিলা আর পশ্চিমবঙ্গের এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক ভিড়ের চাপে মারা গেলেন। বিকেল-সন্ধে থেকেই মেলামাঠে ঘোষণা হচ্ছিল, স্টেশনে খুব বেশি ভিড় হয়ে গিয়েছে। যাত্রীরা যেন মেলামাঠের রেল কাউন্টার থেকে টিকিট কেনেন!
কত ভিড়? সাড়ে তিন কোটির মধ্যে দু’লক্ষ! ফেরা হল না ১০ জনের।

কুম্ভ থেকে ফেরার পথে পদপিষ্ট ১০
স্বজন হারিয়ে। ইলাহাবাদ স্টেশনে রবিবার। ছবি: পি টি আই
রেকর্ড ভিড় হতে পারে, জানা ছিল। প্রশাসনিক প্রস্তুতিও ছিল। তবু শাহীস্নানের ভিড়ে ঘটে গেল দু’দু’টি দুর্ঘটনা।
রবিবার মেলামাঠেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন দু’জন। তাঁদের মধ্যে এক জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। তার পর সন্ধেবেলায় ইলাহাবাদ স্টেশনে পদপিষ্ট হলেন অন্তত আরও ১০ জন পুণ্যার্থী। ভিড় সামলাতে গিয়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করায় পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে বলে রেলমন্ত্রী পবন বনশল স্বীকার করে নিয়েছেন। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ৬ নং প্ল্যাটফর্মে পটনার ট্রেন দেওয়া হয়েছিল। মানুষের স্রোত সে দিকে যাচ্ছিল। প্রথমে ওভারব্রিজ থেকে নীচে পড়ে যান এক মহিলা। তার পর একটি দিকের রেলিং-ই ভেঙে পড়ে। রেলমন্ত্রীর বক্তব্য, “আজ ১৫০টি ট্রেন চালানোর কথা ছিল। কিন্তু চলেছে মাত্র ৭৫টি ট্রেন। কেন, তা তদন্ত করে দেখা হবে।” মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব জানিয়েছেন, পুলিশের তরফে বেনিয়ম হয়েছে কি না, তারও তদন্ত হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.