এ যেন ঘরে ফেরার গান।
জীবনের প্রথম রেট্রোস্পেকটিভ বা পূর্বাপর প্রদর্শনীটির জন্য যোগেন চৌধুরী বেছে নিলেন শান্তিনিকেতনকেই। গত ২৬ বছর ধরে তাঁর ঠিকানা সেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। আজ, সোমবার সূচনা হচ্ছে শিল্পীর প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনীর।
তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীর সুবর্ণজয়ন্তীও এ বছর। ১৯৬৩-তে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। তার পরে গত পঞ্চাশ বছরে চেন্নাই, দিল্লি, আমদাবাদ, বেঙ্গালুরু এবং দেশ ছাড়িয়ে প্যারিস, জাপান, লন্ডনে যোগেন চৌধুরীর বহু একক প্রদর্শনী হয়েছে, কিন্তু ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’ কখনও হয়নি। পঞ্চাশের দশকে, যোগেন যখন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের সদ্য-ছাত্র তখন থেকে শুরু করে তাঁর কাজের বিবর্তন চাক্ষুষ করার সুযোগ শিল্পরসিকেরা পাননি।
জীবনের প্রথম পূর্বাপর প্রদর্শনীটির জন্য শান্তিনিকেতনকেই বাছলেন কেন? “আসলে এখানে কোনও দিনই গুছিয়ে সে অর্থে প্রদর্শনী করে উঠিনি, অথচ ১৯৮৭ থেকে টানা এখানেই আছি। তাই এ বার একেবারে নিজস্ব সংগ্রহ থেকে ১৭৫টি কাজ দিয়ে জীবনের প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভটা এখানে করলাম। পরে অবশ্য এ প্রদর্শনী বিভিন্ন শহরে যাবে,” বলছেন যোগেন। আর, এই প্রদর্শনী কলাভবনের শিক্ষক যোগেন চৌধুরীর পূর্বাপর কাজ নিয়ে, এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের জন্য, জানালেন কলাভবনের অধ্যক্ষ অশোক ভৌমিক। |
ছাত্রাবস্থার কলকাতা, তার পরে প্যারিস, চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ), দিল্লি ও শান্তিনিকেতন শিল্পজীবনের এই পাঁচ পর্যায়ে সাজানো এই প্রদর্শনীতে শিল্পী হিসেবে যোগেন চৌধুরীর হয়ে ওঠাটাই ধরা হয়েছে। বাইরের কোনও সংগ্রহ থেকে ছবি নেওয়া হয়নি, এর জন্য শিল্পীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ১৯৫৫ থেকে ২০১২-র মধ্যে আঁকা ছবি নিয়ে সাজানো এ প্রদর্শনীতে দেখা যাবে তাঁর আদি-পর্বের বেশ কিছু দুর্লভ ছবিও।
১৯৪৭-এ দেশভাগের কিছু আগে মা-র সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। আট বছরের যোগেন থাকতেন পুলিশকর্মী কাকার কোয়ার্টারে। সে বাড়ির দেওয়ালেই লাল-নীল পেন্সিলে জীবনের প্রথম ছবিটি এঁকেছিলেন, একটি ময়ূর। বছর চারেক পরে ঠাঁই হল ঢাকুরিয়ার উদ্বাস্তু কলোনিতে। হ্যারিকেনের আলোয় তেল কিংবা প্যাস্টেল রঙে আঁকতেন ভাই বা বোনের প্রতিকৃতি। তার পরে সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়মিত শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে ছবি স্কেচ আঁকতেন। প্রথামাফিক সে সব কাজের ভিতরে ভিতরেও খোঁজ চলছিল নিজস্ব ভাষার, সে সন্ধান আরও তীব্র হল প্যারিস, চেন্নাই এবং দিল্লি-পর্বে। তবে শিল্প সমালোচকদের মতে, তুলি-কালির যে ড্রয়িং আজ তাঁর স্বাক্ষরশৈলী হয়ে উঠেছে, তার ভাষা খুঁজে পাওয়া এই শান্তিনিকেতনেই।
১৯৮৭-তে কলাভবনে চিত্রকলা-বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন যোগেন চৌধুরী। পরে কলাভবনের অধ্যক্ষ হয়েছেন। এখন ‘এমেরিটাস প্রফেসর’। কিন্তু শান্তিনিকেতনে শিল্পশিক্ষার খোলামেলা ধারার অনুসরণেই যেন, ছাত্রছাত্রীদের কাছে বরাবর ‘যোগেনদা’।
লাল-নীল পেন্সিলে আঁকা সেই ময়ূর পঞ্চাশ বছর ধরে খ্যাতির পেখম মেলেছে বিশ্বজুড়ে। তবু আজ বিকেল ৪টেয় নন্দন আর্ট গ্যালারিতে ১৮ দিনের যে প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করবেন সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার শিল্পী, শান্তিনিকেতনের ‘যোগেনদা’ই। ফিরব বললে, ফেরা যায় তবে! |