শিক্ষার আয়োজন মাটি, জ্যান্ত মাছ দেখতেই ভিড়
মাছের তেলে মাছ ভাজারই রকমফের। সরকারি খামারে বেড়ে ওঠা মাছ পুকুরে ফেলে আবার ধরা হচ্ছে। সেই মৎস্য-অবতারই মাটি-উৎসবে সুপারহিট!
সে-দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বনস্পতি বিশ্বাস। বর্ধমানের সহ-মৎস্য আধিকারিকের আফসোস, মাঠের মাঝখানে খোঁড়া পুকুরই হোক বা দফতরের স্টল, জ্যান্ত মাছই প্রচারের সব আলো কেড়ে নিচ্ছে। “ইসস! মাছ চাষের সারের কত নমুনা এনেছি! হাতে-হাতে পুকুরের জল পরীক্ষার বন্দোবস্ত। সব মাটি!” লোকে দেখছে কই? এমন সময় দেশি মাগুরের হ্যাচারি মালিক রফিক আহমেদ এসে বনস্পতিবাবুর মুখে হাসি ফোটালেন। নানা কিসিমের ফিশ-ফিডের খবরাখবর মনের নোটবুকে টুকে নিয়ে রফিক ‘স্যার’কে ধন্যবাদ জানালেন।
রবিবারের ছুটির বিকেলে বনস্পতিবাবুর অভিজ্ঞতা বলছে, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি জানতে আগ্রহী লোক এই তল্লাটে মেরে-কেটে পাঁচ শতাংশ। গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে টুকরো ছড়ার ছড়াছড়ি। যেমন, ‘ছাগল পালন করলে ভাই, ভাত কাপড়ের অভাব নাই’। বা ‘পচা পুকুরে করলে পালন/পাঙাশ দেয় অধিক ফলন’। সপ্তাহান্তে আমুদে জনতার সে-সবে মাথাব্যথা কম। মোবাইলে খামারজাত টার্কির ছবি তুলতেই লোকে ব্যস্ত। হস্তশিল্প মেলার আদলে খেলনা-পুতুল-মাটির গয়না নিয়েই মশগুল জনগণ।
এ ভাবেই খাঁ খাঁ করছে বিভিন্ন স্টল। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
বর্ধমানের কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তার স্ত্রী উত্তর ভারতের মানুষ। গ্রাম-বাংলার এমন চমৎকার ‘ফিল’ পেয়ে তিনি কৃষিসচিব সুব্রত বিশ্বাসকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানালেন। ওই মহিলার স্বামী প্রিয়দর্শী সেন মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া ড্রেস-কোড অক্ষরে অক্ষরে মানছেন। মাটিরঙা কোঁচানো ধুতি-পাঞ্জাবি সামলে সাবলীল ভঙ্গিতে মেলাময় ঘুরে মন দিয়ে ডিউটি করছেন। রবিবার কলকাতা জেলা সিপিএমের সমাবেশে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য একটা কূট প্রশ্ন তুলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাঁর মন্ত্রীদের মাটি রঙের পাঞ্জাবি পরতে বলেছেন! এ রাজ্যের নানা অঞ্চলে মাটির রং নানা রকম। কোন রং উনি চাইছেন?”
এই বাঙালিয়ানা বা গ্রাম-বাংলার মুখটুকুই হাতের পেন্সিল। কলকাতার রাস্তায় মাটি-উৎসবের বিজ্ঞাপন দেখে সপ্তাহান্তে গাড়ি চালিয়ে টালিগঞ্জ থেকে পানাগড়ে এসেছিলেন সপরিবার দেবার্ঘ ভট্টাচার্য। ঘুরে-টুরে বললেন, “ব্যাপারটা মেলার মতোই, তবে শান্তিনিকেতনে কী যেন হয়, পৌষমেলার মতো নয়।” পেশায় ব্যবসায়ী দেবার্ঘর বক্তব্য, “দেখুন একটু বেড়ানো, মজা বা আমার কলকাত্তাইয়া ছানা দু’টোকে একটু গ্রাম দেখানোর জন্য সব ঠিকই আছে। তবে জনগণের টাকা সত্যিকারের গ্রামকে সাজানোর কাজে খরচ করলেই ভাল হত! তা নয়, এ যেন পুতুল-খেলা!” সূর্যবাবুর মন্তব্য, “মাটি, পুকুর, মাছ এ সব থেকে মাটি টাকা, টাকা মাটি, এ-ই তো হচ্ছে!” নরেন্দ্রপুরের কৃষি শিক্ষণ কেন্দ্রের জৈব-গ্রামে খাঁচায় বন্দি খরগোশ বা জলে ল্যাটা মাছ দেখতে মেলা ভিড়। জনতাকে কিছু শেখানো বা বোঝানোর কেউ নেই। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করতে আসার আগে ওই গ্রামেই কেঁচো সারের গুণাগুণ শুনছিলেন অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের দুই কর্মী। কিছু জমিজমা আছে। তাতে কাজে লাগাবেন। এমন উৎসাহী খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে।
মৎস্য দফতরের পুকুরের জল পরীক্ষার মতোই কৃষি দফতরের মোবাইল ভ্যানে ভূমি জরিপ বা সয়েল টেস্টিংয়ের ব্যবস্থাও দাগ কাটতে পারেনি। ভরদুপুরে কৃষি দফতরের রসায়নবিদেরা আগ্রহী কৃষকের অপেক্ষায়। তার মধ্যে এক গেরো! মাটি পরীক্ষা করে রোগ ধরে ফেললেও সফ্টঅয়্যারের গোলমালে কম্পিউটারে প্রেসক্রিপশন লিখতে সমস্যা। কি-বোর্ড পিষতেই বাংলা হরফে ফুটে উঠছে, ‘সয়লে হলে্থ কারড। পশ্চমিবঙ্গ সরকার।’ সহ-কৃষি রসায়নবিদ বিদেশরঞ্জন সীট বললেন, “কী আর করা! আমরা চাষিদের ডাকযোগে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব।” আউশগ্রামের দেবসলা গ্রামের কৃষক পরিবারের দুই বধূ কনিজা বেগম ও ময়না বেগম ভরদুপুরে রোদ মাথায় এসেছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এক ‘দিদি’ গাড়ি পাঠিয়ে তাঁদের মেলার মাঠে এনেছেন। সেমিনার শোনার জন্য। উদ্বোধনী-আসরে যে মঞ্চে বাউল-শিল্পীরা জড়ো হয়েছিলেন, সেখানে রোজই এখন নানা দফতরের সেমিনার। কৃষি বিপণন দিবসে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সুগন্ধি চালের সাতকাহন শোনাচ্ছিলেন। চড়া রোদে ঘোমটা মাথায় ময়না-কনিজারা তখন ক্লান্তিতে প্রায় ঢুলে পড়ছেন। সেমিনারের খান তিরিশ দর্শক-শ্রোতার মধ্যে অনেকেই সরকারি আমলা। স্টলে সুগন্ধী চাল নিয়ে আগ্রহ থাকলেও চাল বা ধানের বীজ মিলছে না কোনওটাই। ফুলিয়া কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কর্তা অনুপম পাল জনে-জনে বিস্মৃত কাঁঠালি চাঁপা বা রাধাতিলকের গন্ধ শোঁকাচ্ছেন।
তাতেই বাংলার হারানো সুগন্ধ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে।
কৃষি সচিব সুব্রতবাবু অবশ্য মেলায় মানুষের সাড়া দেখে খোশমেজাজে। কেউ কেউ বলছিলেন, পানাগড়ে না হয়ে বর্ধমান বা বোলপুরের মতো জায়গায় হলে ঢের বেশি লোক হত। সুব্রতবাবু তা মানতে নারাজ। তিনি বললেন, কৃষি বিপণনের স্টলে সরকারি পাইলট প্রজেক্টের নতুন তেল বার করার যন্ত্র নিয়ে আগ্রহ বেশ জমেছে। পানাগড়ে দার্জিলিং মোড় থেকে দু’কিলোমিটার এগিয়ে মেলার মাঠে পৌঁছতে অবশ্য অনেকেই নাজেহাল। সন্ধেয় রোজই লোকগান, ছৌ নাচ, রাভা নাচ বা যাত্রার জমাটি অনুষ্ঠান। কিন্তু সন্ধে ছ’টা-সাতটার পরে বাস কই? সাংস্কৃতিক আসর শুরুর ঢের আগেই তাই অনেকে বাড়িমুখো হচ্ছেন। তবু যতটা সম্ভব আমজনতার বিনোদনে ফাঁক রাখতে দিচ্ছেন না মেলার স্বেচ্ছাসেবকরা। কাটোয়ার কোশিগ্রামের ক্লাস সিক্সের রাণু মাঝি বড়দের মতো খোঁপা পরে ও ‘লিপিস্টিক’ মেখে ‘ভাদু’ সেজেছে। জামায় ১০ টাকার ক’টা নোট সাঁটা! গানের তালে তালে রোদে ঘামতে ঘামতে তার নাচ চলছে। একটু জলপানের বিরতি। তারপরে ফের হাসিমুখে মেয়েটি নাচ শুরু করল। গৌর ক্ষ্যাপার নামাঙ্কিত মূল মঞ্চের সান্ধ্য অনুষ্ঠান ছাড়াও দুপুরটা মেলার মেজাজ ধরে রাখতে লোকশিল্পীদের এমন ছোট ছোট দলকে দু’চার দিনের মাঠে আনা হয়েছে।
স্থানীয় অজগাঁ বা দুর্গাপুর-পানাগড়ের আগন্তুকেরা এই নানা রঙে মিলে-মিশে একাকার। সব থেকে ভিড় পিঠের কাউন্টারে। মাটির সরায় উনুনে রান্না পিঠের কসরত হাঁ করে দেখছেন শহুরে দেবলীনা বসু, মৌমিতা সিংহরা। মুখ্যমন্ত্রীও তো ক’দিন আগেই জনসভায় বলেছিলেন, পিঠে-পুলি খান! আনন্দে থাকুন! উৎসব করুন! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের এ দিনের মন্তব্য, “এত উৎসব সামলাতে এর পর হয়তো মুখ্যমন্ত্রী এক জনকে উৎসব-মন্ত্রী করে তার ভার দেবেন!’’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.