|
|
|
|
হুল্লোড় |
পরকীয়ার তিন কাহন
শাহরুখ-কাজলদের নিয়ে বিজ্ঞাপন বানাতেন। এখন বানাবেন বাংলা ছবি। নায়িকা ঋতুপর্ণা।
প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তর সঙ্গে আড্ডায় সেই ছবির পরিচালক বৌধায়ন মুখোপাধ্যায় |
পাঁচটা বিজ্ঞাপনের শ্যুট করেছেন শাহরুখ খানের সঙ্গে।
আরও চারটে সানিয়া মির্জাকে নিয়ে।
প্রথম বাঙালি যিনি অ্যাড-ফিল্ম বানিয়ে কান-এ সিলভার লায়ন জিতেছেন।
প্রথম ভারতীয় পরিচালক যিনি পর পর দু’বছর সোনার পদক জিতেছেন স্পাইকস এশিয়াতে।
দু’টি হিন্দি ছবি পরিচালনা করবেন বলে চুক্তিবদ্ধ তিনি।
তবে বলিউডের হাতছানি এড়িয়ে, বৌধায়ন মুখোপাধ্যায় ছবি পরিচালনার হাতেখড়ি দেবেন টলিউডে। পয়লা মার্চ থেকে শ্যুটিং শুরু। ছবির নাম ‘তিনকাহন’। পরকীয়া নিয়ে লেখা তিনটে গল্পের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে ছবি। অভিনয়ে আছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, আশিস বিদ্যার্থী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, জয় সেনগুপ্ত, খরাজ মুখোপাধ্যায়। ছবির জন্য আমস্টারডামে ১৯৭৮ সালের কলকাতার বন্যা তৈরি করা হচ্ছে!
ছোটবেলা কেটেছে কলকাতাতেই। সাউথ পয়েন্ট স্কুল। তার পর সেন্ট জেভিয়ার্স। টেলিভিশন সিরিয়ালের কাজ দিয়ে কলকাতায় কেরিয়ার শুরু। সেখান থেকে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় চলে যান। সেই কাজের সূত্রেই সিনেমার সঙ্গে যোগাযোগ। “যে বিজ্ঞাপন সংস্থাতে কাজ করতাম, সেখানেই ‘পাতালঘর’ বানানো হয়। আমি ছিলাম এক্সিকিউটিভ প্রযোজক। ছবিটা বানানোর সময় ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলাম,” বৌধায়ন বললেন।
তার পর বিজ্ঞাপন সংস্থাটি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায় মুম্বই, সঙ্গে বৌধায়নও। সেখানে নিজের বিজ্ঞাপন সংস্থা খুললেন। প্রচুর বিজ্ঞাপন। তবে ফিচার ফিল্ম বানানোর স্বপ্নটা হারিয়ে যায়নি। “মুম্বইতে প্রচুর বিজ্ঞাপন বানিয়েছি। নাও ইটস পে ব্যাক টাইম ফর মাই সিটি। এই ছবিটি আমার শহরকে ঋণ শোধ করার একটা মাধ্যম,” বলেন তিনি। |
বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ছবি বানানোর কাজ। তিনটি গল্প বেছেছেন ছবির জন্য। প্রথম গল্পের সময়ের পরিধি ১৯২০ থেকে ১৯৫৪। বৌধায়ন নাম দিয়েছেন ‘নাবালক’। একটি ছ’বছরের বাচ্চার ভালবাসার গল্প। দ্বিতীয় গল্প ১৯৭৮ সালের কলকাতাকে নিয়ে লেখা। পরকীয়া নিয়ে লেখা একটা ‘সিঙ্গল রুম ড্রামা’। তৃতীয় গল্পটি তাঁর নিজের লেখা, একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। “ঘটনাটি নিয়ে মিডিয়াতে সে সময় অনেক লেখালিখি হয়েছিল। যাঁরা অভিনয় করছেন প্রত্যেকেই খুব দক্ষ। ঋতুপর্ণার অভিনয় আমার ভাল লাগে। উনি আমার ছবিতে কাজ করছে এতে আমি খুশি।”
পরিচালক নব্বই বছরের বাঙালিয়ানাকে ধরতে চেষ্টা করেছেন শু্যটিং-স্টাইলের মধ্যে দিয়ে। “এ বছর ভারতীয় সিনেমার শতবর্ষ পালিত হচ্ছে। এই একশো বছর ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অগ্রগতিটাও তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ছবিটা কিন্তু সব স্তরের মানুষের জন্যই,” বলেন তিনি।
ঠিক সেই কারণেই প্রথম গল্পটি শ্যুট করবেন সাদা-কালোতে। তখনও সুব্রত মিত্র ‘বাউন্স লাইট’ আবিষ্কার করেননি। তখনকার দিনে আলো করার স্টাইলটাই অন্য রকম ছিল। হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা নেই। ট্র্যাক, ট্রলিতেই শ্যুট হত। এই সব মাথায় রেখেই প্রথম ছবিটি শ্যুট করেছেন অভীক মুখোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় ছবিতে যে-সময়ের কলকাতা দেখানো হবে তখন শু্যটিং-এর স্টাইল অনেক পাল্টে গিয়েছে। “তখন টেকনিকালার ফিল্ম হয়। ক্যামেরা তত দিনে কাঁধে তুলে নেওয়া যায়। তাই এই অংশটির শ্যুটিংয়ের স্টাইলটাও আলাদা হবে। সে সময় কলকাতায় বন্যা হয়েছিল। ছবিতেও তা থাকছে। কলকাতার বন্যাটা তৈরি হবে আমস্টারডামের স্টুডিওয়। ভিএফএক্স ব্যবহার করব আমরা,” বলেন তিনি।
তৃতীয় ছবিটি সাম্প্রতিক কালের কলকাতা-নির্ভর। যেখানে ‘ডিজিটাল ফিল্ম মেকিং’-এর প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছে। ফাস্ট কাটস, বাউন্স লাইটস, বিজ্ঞাপনের ইমেজারি সব ঢুকে গিয়েছে। এ ভাবেই কলকাতার সিনেমার বিবর্তনটাও ছবিতে ধরা পড়বে। ছবিটি সম্পাদনা করেছেন অর্ঘ্যকমল মিত্র। প্রোডাকশন ডিজাইনার মলয় ভট্টাচার্য। সঙ্গীত পরিচালনা অর্ণব চক্রবর্তীর। কলকাতার ছেলে অর্ণব। বলিউডে ‘ওয়াদা রহা’ গানটি গেয়ে বেশ নাম করেছেন। “তিনটে আমার লেখা গান রয়েছে। আর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। একটা প্রচলিত গান ব্যবহার করছি। অনেকে ভাবতে পারেন যে মুম্বইতে চলে গিয়েছি বলে হয়তো বাংলার সঙ্গে টান কমে গিয়েছে। তবে আমি জোর গলায় বলছি যে, আমি কলকাতার অনেক বাঙালির থেকে হয়তো বেশি বাঙালি। স্ত্রী মোনালিসা প্রযোজক। অবাঙালি, তবে কলকাতায় বড় হয়েছে। বাংলাতে কবিতাও লেখে,” বলেন বৌধায়ন।
বিজ্ঞাপন পরিচালকদের চলচ্চিত্র অনেক সময়ই বেশি চিত্রনির্ভর ছবি হয়ে যায়। ভয় হয় না সেটা নিয়ে? “ব্যালেন্স দরকার। বিজ্ঞাপনে আমরা অনেক সময়ই শটটা ধরে রাখতে পারি না। এগুলো যাতে না হয় তার চেষ্টাই করছি আমি,” জানালেন পরিচালক।
তার পর শুরু হয় বিজ্ঞাপন বানানো নিয়ে নানা গল্প। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন একদিন ভারতের হয়ে খেলবেন। “বাঙালি পরিবারে হয়তো সেটা সব সময় হয়ে ওঠে না। যে বার আমি ‘বেল বাজাও’ ক্যাম্পেন-এর জন্য কান-এ সিলভার পদক জিতি, পরের দিন মুম্বই-এর কাগজে হেডলাইনে ছিল ‘ইন্ডিয়া উইনস ইটস লাস্ট মেটাল অ্যাট দ্য কান’। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যাক ভারতের জন্য তো একটা রুপো পেয়েছি,” বলেই হেসে ফেলেন। |
আমি |
• জন্ম: ১ জুন ১৯৭৩, কলকাতা
• স্কুল: সাউথ পয়েন্ট
• কলেজ: সেন্ট জেভিয়ার্স
• ভালবাসি: ‘ননসেন্স রাইটিং’। নিজে কবিতাও লিখেছি। ননসেন্স রাইটিং-এর একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে আমার কবিতা।
• ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছি তিনশোরও বেশি বিজ্ঞাপনের ছবি। নিউ ইয়র্ক-এর ‘ওয়ান-শো মেরিট’ পুরস্কারটি পরপর দু’বছর জিতেছি।
• শাহরুখের সঙ্গে কেকেআর-এর অ্যাডও শ্যুট করেছি। অন্য একটা বিজ্ঞাপনে পুরুষ অন্তর্বাসের বিতর্কিত অ্যাড বানিয়েছিলাম। পরে সেটি ব্যান হয়ে যায়।
• লর্ডসে কাউন্টি ক্রিকেট থেকে উইম্বলডনে ভেনাস উইলিয়ামস-এর খেলা দেখেছি। সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম এফ-ওয়ান দেখতে। আর মুম্বই থেকে শ্যুটিং সেরে সল্টলেক স্টেডিয়ামে এসেছি মেসির খেলা দেখতে। |
|
শুধু মাত্র ‘বেল বাজাও’ ক্যাম্পেনটা পরিচালনা করেই বৌধায়ন পেয়েছেন মোট ৩০টি পুরস্কার। সারা বিশ্ব জুড়ে। পারিবারিক নির্যাতনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার অ্যাড ক্যাম্পেন ছিল এটি। পাশের বাড়িতে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনার কথা শুনেই সেই দরজাতে গিয়ে শুধু বেলটা বাজিয়ে আসতে হবে। ‘পাবলিক সার্ভিস ফিল্মস’ ছিল এগুলো। ছবিগুলো এত প্রশংসা পেয়েছিল যে আম্তর্জাতিক কান চলচ্চিত্র উৎসবের শর্ট ফিল্ম কর্নারেও এগুলো দেখানো হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক-এর ‘নাইন্থ মিডিয়া দ্যাট ম্যাটারস’ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিজয়ী। স্পেশাল মেনশন পায় মেক্সিকো আর এক্সপ্রেশন এন করটো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।
তবে বৌধায়নের সব থেকে পছন্দের লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডস-এর ট্রফিটি। কারণ? অত সুন্দর দেখতে ট্রফি নাকি তিনি আগে কোনও দিন দেখেননি।
গল্প করতে করতে বলিউডের তারকাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথাও বললেন। অনেকেই মনে করেন কাজল ভীষণ মুডি। তবে বৌধায়নের ধারণা একদম আলাদা। একটি সাত মাসের বাচ্চার সঙ্গে শ্যুট। “সেটে কাজলের মাতৃমূর্তিটাই প্রকাশ পাচ্ছিল। আমাকে বলেছিলেন যদি বেশি সময় লাগে শ্যুট করতে তা হলে যেন আমি ওকে জানাই। বাচ্চাটার উপর যেন বেশি চাপ না পড়ে।”
শ্যুটিং-এর আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন কী ভাবে একটা সাত মাসের বাচ্চাকে দিয়ে তার ছায়াকে চুমু খাওয়াবেন তিনি? “বাচ্চারা কখনও নিজের ছায়াকে পছন্দ করে না। আমি বলেছিলাম ম্যানেজ হয়ে যাবে। শ্যুটিং-এর সময় দেওয়ালের মধ্যে একটা ফুটো করে বাচ্চাটির মাকে তার পিছনে দাঁড়াতে বলেছিলাম। বাচ্চাটা ভাবল মাকে চুমু খাচ্ছে। পরে ভিএফএক্স-এ মায়ের জায়গায় ওর ছায়াটা বসিয়ে দিলাম,” মুচকি হাসলেন বৌধায়ন।
শাহরুখ খান আর অভিষেক বচ্চন সেটে একেবারেই আলাদা। “শাহরুখ একেবারেই নন-ইন্টারফেয়ারিং। প্রথম বার দেখা হওয়ার পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার যদি অপছন্দ হয় আবার তা হলে টেক দেবেন তো? আমার ডাক নাম বাডি। শাহরুখ বললেন, ‘বাডি, তুমি পরিচালক। যতক্ষণ তোমার পছন্দ না হবে আমি টেক দেব।’ শাহরুখের মতো শার্প অভিনেতা আমি খুব কম দেখেছি। ডায়লগ ডেলিভারি অসাধারণ।”
অভিষেক আবার স্ক্রিপ্টে খুব কনট্রিবিউট করতে পছন্দ করেন, বলেন তিনি। “এক বার শ্যুট করার সময় বললাম টপ অ্যাঙ্গেল শট চাই। অভিষেকের প্রশ্ন, ‘আমার পা দেখা যাবে না তো?’ আমি বললাম, না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, ‘ভেরি গুড, আই লাভ ইউ!’ বলেই শ্যুটের জন্য রেডি। হয়তো লম্বা পা-টা সব সময় দেখাতে ভালবাসেন না।” |
বৌধায়নের বিজ্ঞাপনগুলো স্মার্ট। ছবি বানানোর ধরনটা
বেশ অন্য রকম। টলিউডে এই ধরনের ছবি আগে হয়নি
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত |
|
টাইফয়েড থেকে উঠেই সোনম শ্যুটিং করেছিলেন বৌধায়নের সঙ্গে। “লোকে ওকে স্টাইল ডিভা বলেন। তবে শ্যুটিং-এ একেবারেই সাদামাঠা দেখতে লাগছিল ওঁকে। রাত দুটো পর্যন্ত শ্যুট। সদ্য অসুস্থতা থেকে উঠেছেন। তবুও কী পেশাদার। দুটো বিজ্ঞাপনের ছবি একসঙ্গে শ্যুট করলেন,” মনে করতে করতে বললেন তিনি।
আর সানিয়া? “ওকে তো বাচ্চা সাজিয়েছিলাম। স্কুল ড্রেস পরে বিনুনি বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। এই ওর ‘লুক’ ছিল অ্যাড-এ। কিছু দিন পরে উইম্বলডন দেখতে গিয়েছি আমি। কোর্টের সামনে সানিয়ার সঙ্গে দেখা। ওর খেলাটাও দেখলাম খানিকক্ষণ,” বলেন তিনি।
এত বিজ্ঞাপন শ্যুটিং-এর মাঝে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছেন বৌধায়ন। পুরুষ অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন বানিয়ে ঝড় তুলেছেন সারা ভারতে। ক্যাচলাইন ছিল, ‘ইয়ে তো বড়া টোয়িং হ্যায়!’ অশ্লীলতার অভিযোগ এসেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। “সরকার থেকে ব্যান করে দেয় ওই বিজ্ঞাপনটি। দেশে অন্তর্বাসের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত বিজ্ঞাপনের এটাই পরিণতি,” বলেন তিনি।
মাঝে মাঝে মনে হয় না এত কিছু করেও সব সময় পর্দার আড়ালেই থেকে গিয়েছেন কেন? ‘না, সেটা হয় না। বিজ্ঞাপন এটা শেখায়। নামের মোহ করতে নেই। আমরা বিজ্ঞাপন বানাই। সেটা লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। তবে আমরা আড়ালেই থেকে যাই। আমার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি।” |
|
|
|
|
|