|
|
|
|
তারাবাজি |
লেখাপড়া করে যে, ছবিটবি বানায় সে
কেউ অর্থনীতিবিদ, কেউ ডাক্তার, কেউ বিজ্ঞানী। নতুন যুগের
ঝকঝকে বাংলা ছবি বানাচ্ছেন এঁরাই। লিখছেন ইন্দ্রনীল রায় |
• প্রেসিডেন্সি থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে পাশ করেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তার পর সারা ভারতে তৃতীয় হয়ে স্কলারশিপ পেয়ে জেএনইউ থেকে মাস্টার্স। তার পর এম ফিল এনভায়রনমেন্টাল ইকনমিক্সে। পিএইচ ডি করতে করতে তা ছেড়ে দিয়ে ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘হেমলক সোসাইটি’র মতো ছবির পরিচালক।
• জয়েন্ট এন্ট্রান্স মেডিক্যালে আশি র্যাঙ্ক করে কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টার আর ইকবালপুর নার্সিং হোমে দশ বছর প্র্যাকটিস। তার পর মুম্বইতে কিছু দিন বিজ্ঞাপনের কাজ করে কলকাতায় ফিরে ‘উড়ো চিঠি’ পরিচালনা। সবাইকে চমকে দিয়ে শাশ্বতকে নিয়ে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বানিয়ে ফেলছেন ঋত্বিক ঘটকের জীবন অবলম্বনে ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এখন ব্যস্ত দেবকে নিয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’ বানাতে।
• মৈনাক ভৌমিক ছোটবেলা থেকে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের বাসিন্দা। কলকাতায় কিছু দিন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়লেও অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কলকাতায় ফিরে এসে প্রথমে ‘আমরা’, ‘বেডরুম’ আর ‘মাছ মিষ্টি মোর’ বানিয়ে টালিগঞ্জে হটশট পরিচালক।
• কম যান না ‘পদক্ষেপ’ কিংবা ‘নোবেল চোর’-এর মতো ছবির পরিচালক সুমন ঘোষও। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে মাস্টার্স। কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি। এখন পড়াচ্ছেন ফ্লোরিডা অ্যাটলান্টিক ইউনিভার্সিটিতে।
|
একটা সময় ফিল্ম লাইন মানে একটাই ‘ইমেজ’ ছিল। অল্প শিক্ষিত, বখাটে, উচ্ছৃঙ্খল। টলিউডও তার ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু গত কয়েক বছরে টালিগঞ্জে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে তাতে অনেক বস্তাপচা ধারণাই, ‘বাপি বাড়ি যা’ হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ করে এক ঝাঁক উচ্চশিক্ষিত পরিচালক, টেকনিশিয়ান এসে গিয়েছেন যাঁরা দিবারাত্রি বাংলা ছবি নিয়ে ভাবছেন, হিট ছবি করছেন। বদলে দিচ্ছেন টলিউডকে।
এক সময় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো শিক্ষিত পরিচালকদের কাজ করার একটা ঘরানা ছিল। মাঝখানে সেই ঘরানাটা হারিয়ে যায়। আনন্দের বিষয় সেই ঘরানারই প্রত্যাবর্তন ঘটছে।
তাই আজকের দিনে সৃজিত, মৈনাক, কমলেশ্বররা আর সংখ্যালঘু নন। তাঁরাই মেজরিটি।
যেমন ধরুন অনীক দত্ত। গত বছরে সব চেয়ে বড় হিট ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর এই পরিচালক সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র। সেখান থেকে বিএসসি পাশ করেছেন অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস’ নিয়ে মাস্টার্স করতে করতেই চলে আসেন সিনেমায়।
রয়েছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকও। কৌশিক নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। সঙ্গে বিএড। সুমনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে মাস্টার্স। |
সৃজিত| জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স |
সুজয়| এমবিএ, ম্যাঞ্চেস্টার বিজনেস স্কুল |
|
|
|
প্রথম ছবি ‘জিও কাকা’র পর আবার ‘হাওয়াবদল’ নিয়ে পরিচালনায় ফিরছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনিও যাদবপুর থেকে ইংরেজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে ব্রিস্টল থেকে ফিল্ম প্রোডাকশন নিয়ে মাস্টার্স।
“এটা দারুণ ট্রেন্ড,” বলছিলেন সৃজিত।
কিন্তু পড়াশোনা কী ভাবে সাহায্য করে সিনেমা বানানোর সময়?
“পুঁথিগত বিদ্যা হয়তো সে রকম সাহায্য করে না। কিন্তু পড়াশোনা যাঁরা করছেন তাঁদের একটা বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকে। আর যেহেতু পড়াশোনা করার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আছে, তার অধ্যবসায়টা সিনেমা তৈরিতেও দারুণ সাহায্য করে,” জানাচ্ছেন সৃজিত।
তারঁ সঙ্গে একমত অনীক দত্তও। “আমি সৃজিতের সঙ্গে একমত। আর একটা ব্যাপার যোগ করতে চাই। পড়াশোনা এক ধরনের ব্যাপ্তি দেয়। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, এই মুহূর্তে কী ট্রেন্ড, সেই ট্রেন্ডটা সঠিক ভাবে ধরতে পারাটা কিন্তু পড়াশোনা থেকেই আসে,” বক্তব্য অনীক দত্তের।
আজকের টালিগঞ্জে অবশ্য শুধু পরিচালনাতেই নয়, সব বিভাগেই পড়াশোনা জানা ছেলেমেয়েদের ছড়াছড়ি। ধরুন, এই মুহূর্তে টালিগঞ্জের সুপারস্টার ক্যামেরাম্যান সৌমিক হালদারের কথা। ‘চ্যাপলিন’, ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘আমি আদু’, ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-এর পরে সৌমিক এখন টলিউডের হট প্রপার্টি।
প্রসেনজিৎ, জিৎ, দেবের ডেট পেয়ে যাবেন, কিন্তু সৌমিকের পাবেন না। তিনি বিএসসি পাশ করে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছেন মোশন পিকচার ফোটোগ্রাফি নিয়ে। অথবা ধরুন সম্পাদক বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তিনিও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করে এসআরএফটিআই থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন সম্পাদনা নিয়ে। |
মৈনাক| নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স |
কমলেশ্বর| জয়েন্ট এন্ট্রান্স মেডিক্যালে ৮০ র্যাঙ্ক |
|
|
|
“পড়াশোনা জানা থাকলে আত্মবিশ্বাসটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসে। অনেকেই আছেন যাঁরা ছবি বানাতে চান। কখনও কখনও ভাবেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ছবি বানাবেন বা ফিল্ম লাইনে কাজ করবেন। দয়া করে তাঁরা যেন তা না করেন। আগে পড়াশোনাটা করে নিয়ে এলে অনেক লম্বা ইনিংস তাঁরা খেলতে সক্ষম হবেন,” বলছিলেন মৈনাক ভৌমিক।
পড়াশোনার নতুন ধারাটা যে কেবল বাংলাতেই এসেছে তা নয়।
ধরুন বেদব্রত পাইন বা সুজয় ঘোষের কথা। প্রথম ছবি ‘চিটাগং’ বানিয়ে অনেককেই চমকে দিয়েছেন বেদব্রত। তিনি মাধ্যমিকে তৃতীয়, উচ্চমাধ্যমিকে চতুর্থ, আইআইটি খড়্গপুরে ক্লাসে প্রথম। তার পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে পিএইচ ডি।
‘বিদ্যা বাগচি’র স্রষ্টা সুজয় ঘোষও পড়াশোনাতে কম যান না। কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স। সঙ্গে ম্যাঞ্চেস্টার বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ। “পড়াশোনা একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেয় জীবনে,” গল্প করতে করতে বলছিলেন সুজয়।
এ রকম একটা উচ্চশিক্ষিত গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে পেরে খুশি প্রযোজকেরাও। তাঁরাও আজকে যথেষ্ট শিক্ষিত। মণি আর শ্রীকান্তের অফিসে গেলে দেখা যায়, তাঁরা সর্বক্ষণ ওয়ার্ল্ড সিনেমা নিয়ে আলোচনা করছেন। ট্যাবলেটে খোঁজ নিচ্ছেন সাম্প্রতিক প্রযুক্তির। |
ইন্ডাস্ট্রির মতে
শিক্ষিত পরিচালক |
সুবিধে |
• সবাই সাহিত্যচর্চা করেন।
• ফিল্ম টেকনোলজি নিয়ে অসম্ভব ওয়াকিবহাল।
• শহরের সাম্প্রতিক ট্রেন্ডগুলো দেখার প্রবণতা।
• চিত্রনাট্যের অনেক খুঁটিনাটি কাজ তাঁরা করতে পারেন।
• পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশন, ফ্লো চার্ট দিয়ে প্রযোজকদের বোঝানো সিনেমার টার্গেট দর্শক কারা, কত বাজেট হবে ইত্যাদি। এটা প্রযোজকদের কাজ অনেক কমিয়ে দেয়।
• সেটে শিক্ষিত একটা পরিবেশ থাকে। |
অসুবিধে |
• ভীষণ জেদি এবং একগুঁয়ে।
• গলফ গ্রিন, লেক গার্ডেন্স, এবং সাউথসিটির বাইরে যে একটা জগৎ আছে সেটা না দেখা।
• সব গল্প কলকাতা কেন্দ্রিক করা।
• মাঝে মধ্যে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রবণতা যা ছবির ক্ষতি করে।
• বাণিজ্যিক বাংলা ছবির বিজনেস মডেল সম্বন্ধে জ্ঞান সীমিত থাকায় ছবি বানানোর সময় নানা সমস্যা দেখা যায়। |
|
আর এক বড় প্রযোজক অশোক ধানুকার ছেলে হিমাংশু। এআইইই পরীক্ষায় সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক ৩৭৩ হওয়ার পর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পাশ করেছেন এনআইটি কুরুক্ষেত্র থেকে। প্রযোজক কৌস্তুভ রায়ও যাদবপুর থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স।
উচ্চশিক্ষিত প্রযোজক রানা সরকারও। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বি টেক করার পর এম টেকও করেছেন।
“মাঝখানে বাংলা ছবি বড্ড বেশি আবেগতাড়িত ছিল, তাই এক সময় শিক্ষিত দর্শক হলবিমুখ হন। আজ নতুন পরিচালকদের শিক্ষা ছবির ভাষা আমূল বদলে দিচ্ছে সারা দেশে। আর শুধু আবেগে চলবে না, নতুন দৃষ্টিকোণ, ভাবনা দর্শকদের মূল চাহিদা,” বলছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
সব দেখেশুনে তাই মনে হয়, আজকের বাংলা ছবি দেখলে সুকুমার রায় হয়তো, ‘কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়/ যাত্রা দলে পাঁচ টাকা পায়’ লাইনটি একটু হলেও ঘুরিয়ে লিখতেন। |
|
|
|
|
|