বাপি শুধু তোমারই জন্য
সেতারের তারগুলোর এখনও মন কেমন করে।
ঠিক যে ভাবে মন কেমন করে তাঁর সঙ্গীত পরিবারের।
আজ ঠিক দু’মাস হল পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রয়াত হয়েছেন।
২০০৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন যে ৬০টিরও বেশি ফেয়ারওয়েল কনসার্টে বাজিয়েছেন তিনি। আর প্রত্যেক বারই অনুষ্ঠান আয়োজকরা বলতেন সেটাই তাঁর ফাইনাল শো। শুনে পণ্ডিতজি হেসে বলতেন, ফাইনাল না, সেমিফাইনাল।
প্রিয়জনকে হারানোর দগদগে ক্ষত শুকিয়ে দেওয়ার পক্ষে দু’মাস যথেষ্ট নয়। সত্যি বলতে কী, একটা গোটা জীবনেও হয়তো সেই শোক ভুলে যাওয়া যায় না। ঠিক সেই কারণেই তাঁর বাবার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট গ্র্যামি পুরস্কারটি আনতে যাওয়ার আগের মুহূর্তে অনুষ্কাশঙ্কর কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন।
মা সুকন্যা আর বাবার মধ্যে প্রায়ই ঠাট্টা চলত মৃত্যু নিয়ে। পণ্ডিতজি বলতেন মারা গেলে সুকন্যা যেন বেশি দেরি না করেন। আর তা শুনে সুকন্যা বলতেন যে, পরের জীবনে নিজেদের মধ্যে বয়সের এই ব্যবধানটাই তিনি চান।
সুকন্যাকে শেষ দেখা গিয়েছিল কালো চশমা পরে পণ্ডিতজির আমেরিকার স্মরণসভায়। কোলে পণ্ডিতজির প্রিয় কুকুর ‘সুকি’। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি।

নাতি জুবিনের সঙ্গে জন্মের পরে পণ্ডিত রবিশঙ্কর
আর অনুষ্কা?
কী ভাবে ভাষায় বর্ণনা করবেন বাবার চলে যাওয়ার পর প্রথম বার হাতে সেতার তুলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা?
কী ভাবে প্রকাশ করবেন ১১ ডিসেম্বরের পর প্রথম বার সান দিয়াগোতে বাবার মিউজিক রুমে ঢুকে মনটা কী ভাবে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল?
কী ভাবে বোঝাবেন যে নার্সিং হোমে শেষ বারের মতো তাঁর বাপিকে বিদায় জানাতে কত কষ্ট হয়েছিল?
“এটা খুবই ব্যক্তিগত একটা অনুভূতি,” বললেন অনুষ্কা। “জানেন, বাপির সঙ্গে আমি একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলাম।” চোখের সামনে দেখেছিলেন তাঁকে চলে যেতে।
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা।
মৃত্যুর পরে বিশ্বজুড়ে কত কী-ই না লেখা হয়েছে তাঁর বাপিকে নিয়ে। কখনও কি অনুষ্কার মনে হয়েছে কোনও কোনও ব্যাপারে তাঁর বাবাকে হয়তো মানুষ ভুল বুঝেছে? “প্রত্যেকটা মানুষের একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কেউই পারে না সম্পূর্ণভাবে আর একজনের ব্যাপার নিজের মতো করে আত্মস্থ করতে। তাই ভুল বোঝাটা খুবই স্বাভাবিক। আমার বাবার মতো এত হাই-প্রোফাইল, গুণী এবং স্বনামধন্য মানুষকে ভুল বোঝাটা আরও বেড়ে যায় ঈর্ষাবোধ, তিক্ততা এবং খুঁটিনাটি ব্যাপারে ভুল ধরার প্রবণতা থেকে। এটা তো জীবনেরই রীতি,” বলেন অনুষ্কা।
সেটা মেনে নিয়েই চলতে হয়। অন্তত চলার চেষ্টাটুকু করতে হবে।
তাই বাজিয়েছেন লন্ডনের ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ কনসার্টে। আর দুবাইতে।
তবে যেখানেই যান, বাবার স্মৃতি পিছু ছাড়ে না। মনে পড়ে যায় ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার্জারিটা হওয়ার ঠিক আগের রাতটার কথা। তত দিনে জেনে গিয়েছেন
অনুষ্কাশঙ্কর
বাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও গ্র্যামি মনোনয়ন পাওয়ার খবর। তাঁরা দু’জনেই নির্বাচিত ওয়ার্ল্ড মিউজিক ক্যাটেগরিতে। পণ্ডিতজি নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁর অ্যালবাম ‘দ্য লিভিং রুম সেশনস, পার্ট ১’-এর জন্য। আর অনুষ্কা তাঁর অ্যালবাম ‘ট্র্যাভেলার’-এর জন্য। ‘ট্র্যাভেলার’ মুক্তি পেয়েছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। গত বছর এর প্রকাশ অনুষ্ঠানের জন্য খুব বড় মাপের ট্যুর করেছিলেন অনুষ্কা। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়া জুড়ে প্রায় ৬০টির মতো কনসার্ট করেছিলেন।
বাবা বনাম মেয়ে।
গুরু বনাম শিষ্যা। এই নিয়েই খুনসুটি চলত দু’জনের।
গুরু আশা করতেন শিষ্যা জিতবে। ও দিকে গুরুর পাশাপাশি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হত শিষ্যার। “তখনকার ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার মূল্য আমাদের কাছে তেমন কিছু ছিল না। তবু আমি খুশি যে এটা এমন সময় হয় যে আমরা দু’জনেই আনন্দটা ভাগ করে নিতে পেরেছিলাম,” বললেন অনুষ্কা।
বিজয়ী কে হবেন তা নিয়ে ভাবেননি বিশেষ। প্রতিযোগিতা নয়, বরং গুরুর সঙ্গে পুরস্কারের মনোনয়ন ভাগ করে নেওয়াটাই কৃতিত্বের। “বাবার মতো এমন একজন লেজেন্ডের সঙ্গে মনোনয়ন পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। পাশাপাশি তো হিউ মাসেকেলার মতো লেজেন্ডও ছিলেন। ছিলেন অন্য বড় মাপের সঙ্গীতজ্ঞরাও। কিন্তু বাবার সঙ্গে মনোনয়ন পাওয়াটা সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। খুব উপভোগ করেছি ব্যাপারটা,” অনুষ্কা আবারও বলেন।
পণ্ডিতজি এই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারটির ব্যাপারে জানতে পেরে কী করেছিলেন? তাঁর মতো এমন এক কিংবদন্তি শিল্পী, যিনি এত দিন ধরে এত পুরস্কার পেতে পেতে অভ্যস্ত, এই পুরস্কারটির কি কোনও বিশেষ তাৎপর্য ছিল তাঁর কাছে?
“তাঁকে ঘনিষ্ঠ ভাবে যাঁরা জানেন, এটা তাঁদের অনেকেরই জানা যে পুরস্কার ওঁকে সন্তুষ্ট করত। কিন্তু আলাদা করে কিছু বোঝা যেত না। জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও মিউজিকের ক্ষেত্রে সমস্ত বড় বড় পুরস্কার উনি জিতেছেন। ১৭টি সম্মাননীয় ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টটাও নতুন যোগ হল সেই সুদীর্ঘ পুরস্কার-তালিকায়। দিস ওয়াজ সিম্পলি আ নিউ অনার। বাপি নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন। তবে এটা ওঁর কাছে আলাদা করে কোনও আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি। জীবন চলছিল জীবনের মতোই। স্বাভাবিক ছন্দে,” বললেন অনুষ্কা।
শঙ্কর পরিবারের কাছে হয়তো এটাই অভ্যেস। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসা যে পরিবারের লোকেদের কমবেশি প্রত্যেকের নামের সঙ্গেই একটা না একটা সম্মাননীয় পুরস্কারের মনোনয়ন থাকে তাদের ক্ষেত্রে পুরস্কার নিয়ে মাথাব্যথাটা তাই কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে না।
এই বছরে গ্র্যামি, অস্কার বা বাফতাই বলুন, এই পরিবারের কেউ না কেউ একটা একটা মনোনয়ন ঠিকই পেয়েছেন। ‘ট্র্যাভেলার’ অ্যালবামের জন্য যদি অনুষ্কা এ বছর গ্র্যামি পুরস্কারের তাঁর কেরিয়ারের তৃতীয় মনোনয়নটি পেয়ে থাকেন, তা হলে তাঁর ‘হাফ সিস্টার’ নোরা জোনস্ও কিছু কম নন। তাঁর গাওয়া একটি গানের মনোনয়ন আছে অস্কারে।
তা ছাড়াও রয়েছেন অনুষ্কার স্বামী পরিচালক জো রাইট।
এই ব্রিটিশ পরিচালকের তৈরি ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, এবং ‘অ্যাটোনমেন্ট’ আগেও অস্কার মনোনয়ন পেয়েছে। কিয়ারা নাইটলে এবং জুড লয়ে’র অভিনয়ে বড় পর্দায় লিও তলস্তয়ের ‘অ্যানা কারেনিনা’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। জো’র হাতে রয়েছে এখন ছ’টি বাফতা এবং চারটি অস্কার মনোনয়ন। চারটি অস্কার মনোনয়নের মধ্যে একটি মনোনয়ন পেয়েছে মৌলিক সুরসৃষ্টির জন্য। ঘটনাচক্রে এই ছবির সুরারোপের ব্যাপারে অনুষ্কারও ছোটখাটো অবদান আছে। ছবিতে তিনি বাংলায় একটি ঘুমপাড়ানি গানে সুর দিয়েছেন। গানটি গেয়েছেন অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়।

স্বামী জো রাইটের সঙ্গে অনুষ্কা
অস্কার মনোনয়নের এই ব্যাপারটা কেমন লাগছে অনুষ্কার? বিশেষ করে পুরস্কারটা যখন সেই গানের জন্য যেটা গেয়ে অনুষ্কা ঘুম পাড়াতেন ছেলে জুবিনকে? “সমস্ত কৃতিত্বই প্রাপ্য অসাধারণ সুরকার দারিও মারিয়ানেল্লি এবং আমার স্বামী জো রাইটের। জো আর দারিও একসঙ্গে কাজ করেছে। আমি তো একটা খুদে ঘুমপাড়ানি গানই তৈরি করেছি। তবে ছবিটার সঙ্গীত পরিচালনা আমাকে মুগ্ধ করেছে,” বললেন অনুষ্কা।
যশের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। অনুষ্কার হাফ সিস্টার নোরা জোনস্ আমেরিকান সিনেমা ‘টেড’-এর টাইটেল গানটি গেয়েছেন। গানটির নাম ‘এভরিবডি নিডস্ আ বেস্ট ফ্রেন্ড’। “নোরার গানের সুবাদে ‘টেড’-এর পরিচালক সেথ ম্যাকফারলানও অস্কার মনোনয়ন পেয়েছেন,” গর্বিত অনুষ্কা বলেন।
এত মনোনয়ন! তার পরেও মাটিতে পা থাকে কী করে?
“এটা ঠিক যে একটা মাত্র পরিবারের পক্ষে এতগুলো পুরস্কারের মনোনয়ন পাওয়া অসাধারণ ব্যাপার। এত সব মনোনয়নের মধ্যে আমাকে সব চেয়ে নাড়া দেয় বাপির হয়ে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার’ নিতে যাওয়ার মুহূর্তটা। আমি আর নোরা একসঙ্গে যাব পুরস্কার নিতে। তবে আমার স্বামী আর বোনের জন্যও আমি গর্বিত। পুরস্কার মনোনয়ন ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব মজা করি। এই সব অভিজ্ঞতা জীবনে নম্র হতে শেখায়। জীবনের অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে পুরস্কার বা সাফল্য নিয়ে মাতামাতি করার লোক আমরা নই। পারস্পরিক ভালবাসা, মানসিক যোগাযোগ, পরিবারের আনন্দ, শিল্প, এমনকী ভাল খাবারের গল্পও অনেক বেশি গুরুত্ব পায় আমাদের কাছে,” বলেন অনুষ্কা।
আর খুদে জুবিন?
মার গ্র্যামি মনোনয়ন। মাসি এ বার অস্কারে গান গাইবেন। বাবার অস্কার আর বাফতার মতো পুরস্কারের মনোনয়ন। পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো একজন দাদু। কী ভাবে তাকে
নোরা জোনস
আর পাঁচটা বাচ্চার মতো করে বড় করছেন অনুষ্কা? “জুবিনের পক্ষে স্বাভাবিক শৈশব পাওয়া সম্ভব নয়। সেই চেষ্টাও কোনও দিন করব না। ওকে ব্যালেন্সড্ ভাবে বড় করার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করব পৃথিবীর সব রকম শিল্পের আর শিল্পীদের ওর সঙ্গে পরিচয় করানোর। সারা পৃথিবী জুড়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। আমাদের ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে জুবিনও যেন পৃথিবীটাকে চিনে নিতে পারে। ও এখন দু’বছরের বাচ্চা। পুরস্কারের ব্যাপারে কিছুই বোঝে না। তবে আমরা কী বাদ্যযন্ত্র বাজাই সেটা ভালমতো জানে। মিউজিকের সঙ্গে নাচতেও ভালবাসে। এগুলোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
আর অনুষ্কার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হল তাঁর পরের অ্যালবাম। কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। “খেপে খেপে কাজ করেছি ওটাতে। গত বছর ‘ট্র্যাভেলার’ অ্যালবামটা নিয়ে ট্যুর করার ফাঁকে ফাঁকে আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মাঝে। নিতিন স্বাহনে প্রযোজনা করেছেন। আর অনেকগুলো গান আমার বোন নোরাও গেয়েছে,” বললেন অনুষ্কা।
মার্চ মাসে ভারতে প্রথম শো উপলক্ষে আসার কথা নোরার। সোলো শো। ভবিষ্যতে কোনও দিন হয়তো বোনের সঙ্গে শো করবেন।
অনুষ্কাও মার্চে ভারতে আসছেন। বিশ্ব নারী দিবসের দিন দিল্লিতে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন তিনি।
আর অবশ্যই তাঁর বাবার স্মরণসভাতেও থাকবেন। ১০ মার্চ।
আবার একবার ফিরে দেখা।
ভারতে এসে।
নিবিড় গোপন স্মৃতিচারণায় ছুঁতে চান সেতারের সেই তারগুলো যারা নীরবে নিভৃতে আজও কেঁদে কেঁদে ফেরে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.