|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্ট [লজ্জা] ঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
আমার বাবা-মা মেয়েদের অত্যন্ত বিনম্র, ভদ্র হওয়ার সমস্ত পরম্পরা শেখানোর যে গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন, বিজয়ার পর গুরুজনদের প্রণাম করতে যাওয়া ছিল সেই কোর্সের একটা আবশ্যিক কম্পোনেন্ট। সে বছরও ত্রয়োদশীর দিন কাছের দু-একটা বাড়ি বিজয়া সেরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম।
যেতে মোটে ইচ্ছে নেই। নতুন জুতো পরে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। বড় হয়েছি বলে কি এত বড় হয়ে গেছি যে তিন বাড়ি এক দানে বিজয়া করে ফেলব? আর তা ছাড়া এরা কেমন লোক, বছরে এক বার এদের বাড়ি বিজয়া করা মানেই বা কী। কিন্তু বাবা কিছুতেই বুঝছে না। আমার ভেতরটা ক্রমে কালো হয়ে আসছে। নতুন জামা নতুন জুতোর হ্যাপার সঙ্গে বড় পিসির বাড়ির ঘুগনি ধীরে ধীরে পেটে জানান দিচ্ছে।
ও দিকে বয়সটা প্রায় এগারো। সদ্য পাখা গজিয়েছে। অতএব মুখ ফুটে বলতেও পারছি না যে আমার ইয়ে, মানে, বড় বাইরে পেয়েছে। মনে মনে ভাবছি ঠিক ম্যানেজ করে নেব, কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না, এসেছি উত্তর কলকাতা, ফিরব সেই দক্ষিণে। বাসে ফিরব, তার মাঝখানে আরও একটা বিরক্তিকর বাড়িতে বিজয়া।
আর যাদের বাড়ি যাচ্ছি, কে হয়, বাবার একটা কাকা না মামা, সে আর তার বউ আমাদের প্রত্যেক বার দেখে খুব বিস্মিত হয়, ভাবে, এরা এ বারও এসেছে? অথচ তাদের প্রতি আমার বাবার শ্রদ্ধা কমে না।
কড়া নাড়তে বাবার কাকা বা মামা দরজা খুলে দিলেন। মুখটা পুরনো গামছার মতো ঝুলে গিয়েছে। ‘এসো’, বলে উনি ঘরে গিয়ে বসলেন, এবং পরিত্যক্ত পার্কের নীরবতা নেমে এল সেই ঘরটায়, বাবার কাকিমা বা মামিমা এলেন বেজার মুখে, প্লেটে দুটি করে মিষ্টি আর মা-বাবার জন্য চা, আমার বড় বাইরে তখন প্রায় বিপদসীমা অতিক্রম করার জায়গায় চলে এসেছে।
এই অবধি তবু ঠিক ছিল, একটু পরে ঘরে হইহই করে ঢুকে পড়ল আঠারো-উনিশ বছরের একটি ছেলে, বাবার বোনের ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, সে দারুণ, আমার আর দিদির সঙ্গে গল্পগুজব হল, আমি ছোট বলে আমায় খ্যাপানোও হল। আমার বেশ রাগ হল। তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুঝলাম, পরিস্থিতি বেগতিক। ধীরে ধীরে হাঁটছি, সবাই ভাবছে জুতোর দোষ, আর মুখে ওই বাড়ির লোকদের যা-তা বলছি কথা বলে না ঠিক করে, দেখেই বোঝা যায় খুব অখুশি, কেমন তেএঁটে, যেন দুটো মিষ্টি খরচ হয়েছে বলে লোকসান হয়ে গেল। মা বকছে, গুরুজনদের সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য শুনে। তবু আমি বলেই চলেছি। আসলে মনটা অন্য দিকে ঘোরাবার প্রাণপণ চেষ্টা।
এবং চেতন শর্মার শেষ বলে মিয়াঁদাদের হাতে ছক্কা খেয়ে যাওয়ার মতো, হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল আমার ভাগ্য। সবে বলেছি ‘আর কোনও দিন, কক্ষনও আসব না ওদের বাড়ি’, বাক্য শেষ হয়নি, এমন জোরসে পেয়ে গেল যে আর কোনও উপায় না পেয়ে ওদের বাড়িতেই ফিরে গিয়ে, ইমার্জেন্সি বিবৃত করে, সেই নিরানন্দ মানুষের মুখের অবাক হওয়ার এক্সপ্রেশন সহ্য করে, সেই ছেলেটার মুচকি মুচকি ব্যাঁকা হাসির ক্ষত নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
কিছুতেই আর বেরোতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল বাথরুমের মাটিটা ফেটে যাক আর আমি ঢুকে যাই। ছি ছি, এ মুখ দেখাব কী করে? আর ওই ছেলেটা, যার কাছে বড় হওয়ার, পাখা গজানোর এত রেলা নিলাম, তার সামনে কিনা এই ভাবে... উফ! |
|
|
|
|
|