|
|
|
|
|
|
|
আজ কপাল পুড়ল: কাঞ্চনমালা-র |
সুমিতা
|
এক
রাজা ছিল, এক রাখাল, আর এক ছিলেন রাজার বালবধূ কাঞ্চনমালা কন্যা জল ঝরঝর
মেঘ থরথর
রূপের বন্যা!
ছোট-কালে যেমন হয়, রাজায়-রাখালে সখা পাতায়। কাঞ্চনমালা দুয়ের সাথেই খেলনাবাটি খেলেন, দুয়ের সাথেই নড়াই-নড়াই খেলেন।
তার পর দিন যায় না ক্ষণ যায়, জল যায় না নদী যায়, দেখিতে দেখিতে কাঞ্চনমালা ডাগর হলেন। চিরকালের মতো অন্তঃপুরের অসূর্যম্পশ্যা!
রাজা গেল গুরুকুলে বিদ্যে-শিক্ষে নিতে তাকেই তো এসে দেশের হাল ধরতে হবে। আর রাখাল গেল গরু-বাছুর, ছাগল-পাগল নিয়ে বনে চরাতে তাকেও তো করে-কম্মে খেতে হবে।
কাঞ্চনমালা অন্তঃপুরে সংসার শিক্তে শিক্তে নিতিদিন চোকের জলে ভাসেন হা আমার মেয়েবেলা, হা আমার রাখাল সখা, হা আমার রাজপতি
কে বা আছিস কোথায় তোরা
কী-ই বা আমার গতি।
পতিকে দেখিয়া কাঞ্চন তো অবাক একে তো সে চিনে না! এর শরীর ভিন্ন, এর মুখ ভিন্ন যেন লক্ষ কোটি সূচ গাঁথা হয়ে আছে এর দেহের চামড়ায়, পশ্শো করলেই ফুটে যাবে। যেন তীক্ষ্ণ, হিংস্র চক্ষুপাতে কন্যার হাওয়াই বেনারসি, বুটিদার ওড়না, চোকের গহিন কাজল, মেঘবরণ কেশের মাঝে গুঁজিয়া রাখা মেয়েবেলার হাত-আয়না সব ছিঁড়ে, কেড়ে, তাকে উদোম করে, গোটা গিলিয়া খাইতে চায় হায় হায় রে হায়
এমন সময় বাসরঘরের দুয়ারে মহা গোলযোগ কারা যেন হইচই করে, কারা যেন কাদের ডাকতে থাকে। বিরক্ত রাজা রাগে গরগর, ধম্ধম্ করিয়া দরোজা খুলিলেন কে? কাঞ্চনমালা ঘোমটা টানিতে ভুললেন, পলক ফেলিতে ভুললেন, আগুয়াইতে ভুললেন, পাছুয়াইতেও ভুললেন।
রাখাল বলিল সখা, তুমি ফিরেছ, চোদ্দো দিগরে ঢোল শহরত হল, নেমন্তন্ন পেল সাত রাজ্যের একুশ লক্ষ মানুষ, আর আমি তোমার সখা, আমার কথাটি তোমার মনে পড়িল না? |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
রাজা তখন ভিরকুটি করে, গোঁপ চুমরে, সূচ ফুলিয়ে বলে ছেলেকালে অমন কত হয়। কত আসে, কত যায়। তুই বনের রাখাল, আমি দেশের রাজা, তোর সাথে আমার কীসের বন্ধুতা?
রাখাল তার মায়াময় চোখ দু’টি কাঞ্চনরানির মুখের পরে রেখে শুধোলে কন্যে, তুইও বুঝি ভুলেছিস আমাকে? স্বামীর লোভে, পুতের মা হবার লোভে, এই আন্ধার কোণে পড়ে থাকিবি? না দেখবি সুয্যের মুখ, না দেখবি মানুষের মুখ?
সেই পাগল-পারা দিষ্টির সামনে কুটোগাছার মতো থরথর করে কেঁপে উঠলেন কাঞ্চন। আর সূচরাজার নিঠুর হাত রাখালের চুলমুঠি ধরে তরোয়ালের এক কোপে প্রদীপ নিবাইয়া দিল। রাজার শতেক পেয়াদা গর্জন করে উঠল তফাত যাও! রানিবৌয়ের দিকে যে চক্ষু মেলে চায়, তার গর্দান যায়।
সাত সমুদ্দুরের আন্ধারে ডুবতে ডুবতে কাঞ্চন বুঝিলেন থইথই রক্তের বাস ভাসে বাতাসে। রাজ-অঙ্গের সকল তীক্ষ্ন সূচ তাঁর অঙ্গে প্রবেশ করে রক্তে ভেসে যায় শ্বেতপাথরের সাতমহল। নিদালি মন্তরের অচেতন ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন কাঞ্চন।
তখনও নিশুত রাত, তিন পহর পার হয়-হয়, সকলই নিথর, কেবল সিথানে সোনার থালে ঘি-এর প্রদীপ মিটিমিটি জ্বলে। সোনার দাঁড়ে শুকপাখি ডানায় মুখ গুঁজে ঘুম যায়। আর ঘুম যায় সূচরাজা, সকল দোষীর শাস্তি করে, সকল রাজ্য জয় করে।
যেন সাতজন্মের ঘুম ভাঙ্গিয়া শেষে কাঞ্চনমালা জাগিলেন। হাওয়াই বেনারসির ছেঁড়া ত্যানায় চোকের জল মুছিলেন, উরুর রক্ত মুছিলেন। মেঘ সরে, জানালার ফাঁকে দেখা যায় উষার শুকোতারা। কন্যা তাঁর মেঘবরণ চুলের রাশি দুহাতে ধরে বলেন
চুল চুল সুতা হও।
সূচরাজার সূচায় যাও।
রাজার ঘরে আবার এল নতুন রানি কাঁকন দিয়া কেনা, নাগন্ দাসী কাঁকনমালা! |
|
|
|
|
|