|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
বেশ কিছু বছর আগে, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মিজানুর রহমানের পত্রিকায় একটা নিবন্ধে পড়েছিলাম: প্রত্যেক জায়গার একটা ল্যান্ডস্কেপ যেমন থাকে, তেমনি থাকে সাউন্ডস্কেপ। সময়ে দুটোই পাল্টাতে পারে, পাল্টায়ও। এক কালে, কলকাতার অনেক পাড়ার সকালের সাউন্ডস্কেপের একটি বড় অংশ ছিল বাড়িতে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে মেয়েদের গলা সাধার আওয়াজে তৈরি। ভোর থেকেই নানান বাড়িতে শুরু হত গলা সাধা। জন্ম থেকে পাঁচ বছর কটকে ছিলাম। গলা সাধা কাকে বলে জানতাম না সেখানে। ১৯৫৫ সালে কলকাতায় চলে এসে ভোর থেকেই দু’টি আওয়াজ কানে আসতে শুরু করল: বাড়িতে বাড়িতে রেডিয়ো বাজছে আর কোনও কোনও বাড়িতে কেউ গলা সাধছে। অল্পবয়সি মেয়েদের গলাই বেশি। আত্মীয়দের বাড়িতে রাত কাটালে তাঁদের পাড়াতেও ভোর থেকে শুনতাম এ-বাড়ি ও-বাড়ি সা রে গ ম প ধ নি সা, সা নি ধ প ম গ রে সা। ধীরে ধীরে। বেশির ভাগই হারমোনিয়ম সহযোগে। খুব কম বাড়ি থেকেই তানপুরার আওয়াজ পাওয়া যেত। শুনতাম গলা-সাধিয়ে প্রথমে সারেগম, তার পর ‘আ-আ’ করছেন। আমাদের বাড়ির মোটামুটি কাছে যাঁরা গলা সাধতেন, মন দিয়ে শুনতাম তাঁদের পদ্ধতি। খেয়াল করতাম প্রতিটি স্বরই তাঁরা কেমন যেন গড়িয়ে গড়িয়ে গাইছেন। সরাসরি সা নয়। তার তলায় শুদ্ধ নি, শুদ্ধ ধা এমনকী পঞ্চম থেকে গড়িয়ে সা। পরে জেনেছি ওটিকে মিড় বলে। তেমনি গলা-সাধিয়ে যখন শুদ্ধ রে স্বরটি লাগাচ্ছেন, তখন সরাসরি রে নয়। সা থেকে মিড় দিয়ে শুদ্ধ রে। এমনকী মন্দ্র সপ্তকের শুদ্ধ নি থেকেও।
দু’এক বার শুনে ফেলেছি হারমোনিয়ম বাজিয়ে অল্পবয়সি কেউ সাত সকালেই গান গাইছেন। মাঝে মাঝে বয়স্ক মানুষের গলা। ‘গানের মাস্টার’ বা বাড়ির বড় কেউ শেখাচ্ছেন। গান শোনা যেত বরং বিকেলে, বিশেষ করে মেয়েদের গলায়। হিন্দি ভজন শোনা যেত প্রায়ই, শোনা যেত ছাত্রীর গলার সঙ্গে শিক্ষক বা শিক্ষিকারও গলা। দু’একটি বাড়ি থেকে ভেসে আসত তবলার সঙ্গত।
আমাদের পুরনো পাড়ায় এক জন হাওয়াইয়ান গিটার শিখতেন। সপ্তাহে এক বার, জামা-পরানো গিটার নিয়ে একটু উঁচু হিলের জুতো পরে গটগট করে বাজনার ইস্কুলে যেতেন তিনি। বাড়িতে নিয়মিত চর্চা করতেন। রাস্তায় খেলতে খেলতে আমরা, ওই গলির ছেলেরা সেই বাজনা শুনতাম। ছেলেদের চেঁচামেচির পরোয়া করতেন না ভদ্রমহিলা। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
কোলের ওপর শুইয়ে এক হাতের আঙুলে প্লেক্ট্রাম পরে, অন্য হাতের আঙুলগুলি দিয়ে একটি স্টিলের বার ধরে তারের ওপর ঘষে ঘষে সুর তোলা হত এই গিটারে। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে ওই বার দিয়ে ঘষে যাওয়া যেত বলে বাংলা গানের মিড় বেশ জুতসই ভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত। জনপ্রিয় ছিল এই গিটার। বেতারে নিয়মিত শোনা যেত হাওয়াইয়ান গিটারে রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক বাংলা গানের সুর। কাজী অনিরুদ্ধ, বটুক নন্দী, কার্তিক বসাক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁরা ছিলেন সে যুগের জনপ্রিয় গিটারশিল্পী। সুজিত নাথ আর একটু আগেকার শিল্পী। বেতারে মাঝে মাঝে শোনা যেত সুজিত নাথ ও তাঁর সহশিল্পীদের বাজানো সুর। মা বলতেন, সুজিত নাথ তাঁর সঙ্গেও বেতারে ও রেকর্ডিং-এ গিটার বাজিয়েছিলেন অর্থাৎ চল্লিশের দশকে। চল্লিশ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গিটারের জনপ্রিয়তার কারণে অনেকেই সে যুগে হাওয়াইয়ান গিটার শিখতেন এবং বাড়িতে চর্চা করতেন। পাড়ার গানের স্কুলেও তখন এই ধরনের গিটার শেখানো হত। কলকাতার ধ্বনিপটে হাওয়াইয়ান গিটারের আওয়াজও ছিল।
সকালের দিকে, এমনকী বেলাতেও কোথাও কোথাও পাওয়া যেত তবলার আওয়াজ। একটানা বাজিয়ে যাচ্ছেন কেউ। রেওয়াজ। কোথাও কোথাও বিকেল ও সন্ধেতেও শুনেছি তবলা। নানান বোল, বিভিন্ন কায়দা। সেতার, সরোদ, বেহালা, এসরাজও নিশ্চই শোনা যেত কোনও কোনও পাড়ায়। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শিখতেন, অতএব রেওয়াজও করতেন নিশ্চয়ই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একাধিক নতুন সেতারশিল্পী ও সরোদশিল্পীর বাজনা শোনা গিয়েছে বেতারে। বেহালাশিল্পীও তৈরি হয়েছেন। অনেকেই স্টুডিয়োশিল্পী হিসেবে নিয়মিত আয় করেছেন। নাটক ও যাত্রাতেও বেহালা ছিল অপরিহার্য। বেতার নাটকে কোনও দৃশ্যে করুণ রসের ছিটেফোঁটা থাকলেই অমনি নেপথ্যে বেহালা। ছড় টেনে বিলাপ।
চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নতুন বাঁশিশিল্পীও এসেছেন। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অলোকনাথ দে-র মতো বাঁশিশিল্পী ও সংগীতপ্রতিভা তো সারা পৃথিবীতেই বিরল। পঞ্চাশের দশকে আকাশবাণীরই আর এক অসামান্য বাঁশিশিল্পী ছিলেন হিমাংশু বিশ্বাস। তাঁর অকালমৃত্যু এক বিরাট জাতীয় ক্ষতি। এঁরা ছাড়াও বাঁশিতে কালক্রমে আমরা অন্য শিল্পীদেরও পেয়েছি। এঁদের অনেকেই কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ। দীর্ঘকাল প্রত্যহ যে যাঁর যন্ত্রে রেওয়াজ করেছেন নিশ্চয়ই। কলকাতার ধ্বনিপটে এই সব যন্ত্রের আওয়াজও নিশ্চয়ই ছিল।
আমাদের পুরনো পাড়ায় পাশের রাস্তায় কে যেন পিয়ানো শিখতেন। সন্ধেয় প্রায়ই শুনতাম একটু দূরে কে যেন ছ’মাত্রার তালে ঠিক চারটি কর্ড বাজাচ্ছেন পিয়ানোয়। কখনও কখনও শুনতে পেতাম ওই চারটি কর্ডের বদলে সে যুগের একটি জনপ্রিয় ইংরিজি গানের সুর: ‘কে সেরা সেরা/ হোয়াটেভার উইল বি উইল বি’। খেয়াল করা দরকার, এই গানটিও তিন মাত্রা বা তিন দু’গুণে ছ’মাত্রা। অর্থাৎ, ওয়াল্ট্স নাচের তাল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছিলাম ওই পাড়ায়। কী একাগ্রতার সঙ্গেই না ওই প্রতিবেশী একটানা অতগুলো বছর ওই একই জিনিস বাজিয়ে গেলেন প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিন সন্ধে। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে ছেলেবেলা থেকেই পিয়ানো দেখেছি, যদিও বেশির ভাগ পিয়ানোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিছক আসবাব। নিয়মিত বাজানো হত না। আর আমাদের পাড়ার যে পিয়ানোটির আওয়াজ এক দশকেরও ওপর শুনেছিলাম, সেটিকে কোনও দিনই চোখে দেখিনি।
চোখে দেখেননি অনেকেই হয়তো দুই পথশিল্পীকে, যাঁরা দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন মার্কেটের সামনে ফুটপাথে থাকতেন। এক জন বাজাতেন একটি মান্ধাতার আমলের একর্ডিয়ন, অন্য জন বেহালা। এঁদের এবং এঁদের সংসার ও যন্ত্র দুটিও দেখেছিলাম আমি ষাটের দশকের একেবারে গোড়ায়। একর্ডিয়নটি ছিল একেবারে রংচটা, যা-তা। মনেই হত না ওটা আদৌ বাজতে পারে। বেহালাটারও দশাও একই। এখানে তাপ্পি, ওখানে তাপ্পি। গ্রীষ্মের কোনও কোনও রাতে তাঁরা দু’জনে পথে পথে বাজিয়ে বেড়াতেন। সে যে কী মধুর, কী মায়াময়! রাতের নগরজীবন ও সংগীত যে কত রোম্যান্টিক হতে পারে, তার পাঠ আমায় কলকাতার ওই দুই পথের শিল্পী দিয়েছিলেন আমার ছেলেবেলায়। এক বার, অনেক রাতে তাঁরা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিলেন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। মা’কে বলে দৌড়ে গেলাম। ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছেন দু’জন। রাস্তায় কেউ নেই। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ নিষ্প্রভ আলোয় দু’জনে অদ্ভুত এক সুর বাজাচ্ছেন। আমার শহরের ল্যান্ডস্কেপে দুই ফুটপাথবাসী নিশাচর শিল্পী। সাউন্ডস্কেপে দু’টি বাজনার সুর, যা আমার, শুধু আমার, চিরকালের মতো আমার। সম্ভবত চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছে আমার শহরের সাউন্ডস্কেপ থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালির পাড়ায় পাড়ায় সাতসকালে গলা সাধা। সা থেকে এখন মিড় দিয়ে নয়, সরাসরি টেলিভিশন চ্যানেল, ছায়াছবিতে প্লে-ব্যাক, সিডি, জলসা। |
|
|
|
|
|