|
|
|
|
|
|
|
কেষ্ট কপূর |
মেয়েটির সম্মতির কোনও দরকার নেই। প্রেম জানাও, পথ আটকাও, হাত ধরে টানো।
হিন্দি ছবির হিরো থেকে পৌরাণিক মাচো, সব্বার এক শিক্ষা। লিখছেন শান্তনু চক্রবর্তী |
ধুপ মে নিকলা না করো রূপ কি রানি
গোরা রঙ কালা না পড় যায়ে!
মিডি-স্কার্ট পরে, হাই-হিল স্টিলেটো খটখটিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ’৮০-র দশকের বলিউড নায়িকা! তার পাশে পাশে কখনও সোজা, কখনও ব্যাক গিয়ারে ইয়া লম্বা লম্বা পা ফেলে চলেছেন বলিউডের বিগ-বিগ মেগা নায়ক! হাতে খোলা ছাতা, ঠোঁটে ওই গান নায়ক বাবাজীবনের উদ্দেশ্য যে আপাত সাধু ও মহৎ, তা নিয়ে ভুরুতে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন পাকানোর কোনও স্কোপ নেই! বেচারি একে বিন্ধ্যপারের নায়িকা, তার ওপরে আশির দশকের কনজিউমার কালচারে সানস্ক্রিন লোশনেরও তেমন হদিশ নেই! সুতরাং, মুম্বইয়ের এই গা-চিটপিটে রোদ্দুরে মেয়েটার ত্বকের যত্ন আর কে নিতে পারেন এই রোমিয়ো-টি ছাড়া! মেয়েটার যাতায়াতের রাস্তায় তিনি তাই ছাতাটি আর পরম সাধু মতলবটি নিয়ে নিয়মিত ওঁৎ পেতে রাউন্ড দেন। এখন মেয়েটা সেই ‘যত্ন’টুকু নিতে বা রোমিয়োবাবুটির সঙ্গে এক ছাতার নীচে পাশাপাশি হাঁটতে রাজি আছেন কি না, এ সব বেকার তক্কো এখানে উঠতেই পারে না। কেননা, নায়কের যখন ইচ্ছে করেছে, তখন শেষ অবধি নায়িকাকে রাজি হতেই হবে! মোহন ভাগবতের ‘ভারত’-এও হবে, বলিউডের ‘ইন্ডিয়া’-তেও হবে।
নায়িকা দু’বার ‘না’ বলবেন, চার বার ‘না’ বলবেন পাঁচ বারের বার ঠোঁটের কোণে আল্লাদি হাসি ভাসিয়ে, সোহাগি রাজহংসীর মতো রোমিয়োর ছাতার তলায় ঢুকবেন, মোটরবাইকের পিলিয়ন-এ চড়ে ভিতু-ভিতু লাজুক হাতে তাঁর কোমর জড়িয়ে বসবেন বা, ঝাঁ-চকচকে নতুন গাড়ির অন্দরে ড্রাইভারের সিটের পাশটায় গিয়ে সেঁধোবেন! নায়িকা যত ক্ষণ গরম, রোমিয়ো-নায়ক তত ক্ষণ নেচে-কুঁদে, সার্কাস-ট্র্যাপিজের খেল দেখিয়ে তাঁর দিল নরম করবেন! নায়িকা যত তেরিয়া হয়ে না-না-না-না বলবেন, রোমিয়ো তত মরিয়া হয়ে মেয়েটার শরীরের কাছাকাছি সরে আসার চেষ্টা করবেন। এবং সেই চেষ্টা যত ঘন, আঠালো, মাখো-মাখো হবে, নায়িকাও ততই খরখরে-জেদি আমসত্ত্ব থেকে তুলতুলে আইসক্রিম হয়ে উঠবেন! তার পর তো মুখে দিলে গলে যায় আহা রে কী পুষ্টি! আর নায়কের বাসনার পুষ্টি মানেই দর্শকের সন্তুষ্টি! এটাই আমাদের দেশি রোম্যান্সের ঐতিহ্য দ্বাপরের কেষ্ট ঠাকুর থেকে ‘সঙ্গম’-এর রাজ কপূর অবধি সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!
সেই নিয়ম বলে, রোমিয়ো-রসিক-প্রেমিক-নাগর প্রেম-ভালবাসা চাইলে সহ-নাগরিকার ‘না’ বলার কোনও জো নেই। সে তুমি অহল্যাই হও কিংবা শ্রীদেবী, নায়িকার মুখে ‘না’ শুনতে ইন্দ্র থেকে জিতেন্দ্র, কেউই পছন্দ করে না। সে কালে ঋষি-কন্যাদের সিডিউস করতে দেবরাজ ইন্দ্রের জুড়ি ছিল না। এমনকী লম্পটপনার সাজা হিসেবে মুনিবর রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর গোটা গায়ে যোনি-চিহ্ন দেগে দেওয়ার শাপ দিলেও ইন্দ্রবাবুর স্বভাব পাল্টায়নি! আর এই পুরো খেলাটাই তিনি খেলতেন তাঁর স্বর্গীয় ‘পাওয়ার’ কাজে লাগিয়ে। ধরেই নিতেন, পাতার কুটিরে ফলমূল খেয়ে থাকা ঋষি-কুমারীরা স্বর্গের ‘সিইও’ হিসেবে তাঁর গ্ল্যামার, ‘ব্র্যান্ডেড’ হাতি-ঘোড়া-রথের চমক-দমক দেখে এমনিতেই চোখ টেরিয়ে কামনা-শরে মুচ্ছো যাবেন। তাই তার পরেও তাদের ওজর-আপত্তি-চোখের জল, এ সবই দেবরাজের মনে হত নখরা, ন্যাকামো, দর বাড়ানোর চিরকেলে মেয়েলি কায়দা! খাঁটি আর্য পুরুষের মতোই তিনি সে সবে পাত্তা না দিয়ে, শরীর গ্রহণ করে তাঁদের সেই তুচ্ছ নারীজীবন ধন্য করতেন। |
|
তবুও পুরাণ-বাজারে ইন্দ্রের ইমেজটা মোটামুটি নারী-ধর্ষকেরই। প্রেম-কলার পাকা খেলুড়ে বলে তাঁর কোনও দিনই তেমন নাম ছিল না। কিন্তু সেই নাম যাঁর আছে, এ দেশের রোম্যান্সচর্চায় যিনি চিরকালের আইকন, আমাদের সেই লীলাময় কেষ্ট ঠাকুরটির মেয়েদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা, ইন্দ্রের চেয়ে কি খুব কিছু আলাদা রকম? হস্তিনাপুরে কৌরব-দরবারে প্রায় ধর্ষণের হাত থেকে ড্যামসেল-ইন-ডিস্ট্রেস দ্রৌপদীর লাজ বাঁচিয়েছিলেন যে কৃষ্ণ, তাঁর কথা কিন্তু এখানে হচ্ছে না! তিনি তো সদা পলিটিক্যালি মহাকারেক্ট, সুশীল-সিভিল নাগরিক কৃষ্ণ মহাভারতের সাক্ষাৎ রাজনৈতিক অবতার। আমরা যে কিষেণ-কান্হাইয়াকে খুঁজছি, তিনি মথুরা-বৃন্দাবনের রাস্তার মস্তান দুধওয়ালা! এলাকার ইভ-টিজার নাম্বার ওয়ান! রোডসাইড রোমিয়ো। তাঁর দৌরাত্ম্যে বৃন্দাবনের গোয়ালিনিরা দুধ বেচতে, জল ভরতে, যমুনায় স্নান করতে যেতে ভয় পায়। গোপিনীদের ভরা-দুধের কলসি তিনি গুলতি মেরে ফাটিয়ে দেন। কাঁচুলি-চোলি-ঘাগরা ভিজিয়ে দুধ নামে ধারায় ধারায়। গোপ-বালিকাদের ঠোঁটে, গালে, খোলা নাভিতে দুধের রেখা ঝরে। যেন মিলনকালে রতিস্নান!
গোপিনীরা নদীপারে জামা-কাপড় রেখে যমুনায় নাইতে নামলে কানাই গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখেন। মেয়েদের ঘাগরা-চোলি-গয়না পুঁটুলি পাকিয়ে কদম গাছের মগডালে বেঁধে রাখেন। তারা ভেজা আদুল গায়ে জল ছেড়ে উঠে না আসা অবধি কালাচাঁদ পোশাক ফেরত দেন না। নগ্ন নারী-শরীর তারিয়ে তারিয়ে দেখে নয়নসুখ করেন। কিন্তু কৃষ্ণলীলা তো আর স্রেফ নিরামিষ ভয়্যারিজ্ম-এ আটকে থাকে না! ওই গোয়ালিনিদের দলে যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে লাজুক, সবচেয়ে নরম, সেই মেয়েটি মানে রাধারানিকেই কৃষ্ণ এ বার টার্গেট করেন। আর রাধার সঙ্গে তিনি যে কাণ্ডকারখানা শুরু করেন, তার পাশে তো বারাসতের দুর্দান্ত ইভ-টিজাররাও গোপালের চেয়ে সুবোধ বালক! বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘দানখণ্ড’ আর ‘নৌকাখণ্ড’টা এক বার উল্টে দেখুন। কৃষ্ণ এখানে প্রায় পাড়ার তোলাবাজ দাদাদের মতোই বৃন্দাবন-মথুরা যাতায়াতের রাস্তায় ‘দানী’ মানে টোল-ট্যাক্স আদায়কারী সেজে থানা গেড়েছেন। তাঁর আসল লক্ষ্য রাধা। রাধার কাছ থেকে তিনি ‘রূপের ট্যাক্সো’ আদায় করতে চান। তিনি এখানে রাধার শরীরকে প্রায় নিলামে তুলছেন! প্রতিটি অঙ্গের দাম হাঁকছেন। চাঁদপানা মুখের দাম ৪ লাখ টাকা চামরের মতো ঘন রেশম চুল ২ লাখ নীলপদ্ম চোখ ৫ লাখ বিম্ব-অধর ৯ লাখ মৃণাল বাহু ১১ লাখ শ্রীফল, মানে পাকা বেলের মতো সুগোল-সুডৌল দুটি স্তন ১৩ লাখ যেন বাতাসে দোলে এমন সরু কোমর ১৪ লাখ টাকা কদলী উরু ১৫ লাখ আর সোনার সিংহাসনের চেয়েও সুন্দর নিতম্ব ৬৪ লক্ষ টাকা। একেবারে ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স মোতাবেক নিখুঁত হিসেব!
কৃষ্ণের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও একদম জলের মতো। হয় তুমি তোমার সাড়ে তিন হাত শরীরের দাম ফেলে দাও, নয়তো আমায় চুুমু-আলিঙ্গন দাও তোমার এই শরীরময় খেলে বেড়াতে দাও! এই কৃষ্ণ দুরন্ত ‘ফিজিক্যাল’ কৃষ্ণ। ইনি কী চান, তা নিয়ে কোনও ঢাকঢাক-গুড়গুড় নেই। ইনি রাধাকে নির্লজ্জ ভাবেই বলতে পারেন ‘বিনি রতি পাইলে তোকে না এড়িবে কাহ্ন’। মানেটা এ রকমই দাঁড়ায় কানাইকে শরীর না দিয়ে তুই যাবি কোথায় শালি! যেন পাঞ্জাবি র্যাপ-শিল্পী হানি সিংহ-র গানের লিরিক। নাছোড় কৃষ্ণকে এড়াতে রাধাও তাঁর বাপ-বাপান্ত করেছেন। কখনও বলেছেন, ভৈরব পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা কর কখনও বলছেন, নদীতে গিয়ে ডুবে মর! আর কৃষ্ণও তো রসের নাগর। তিনি পাল্টা দিচ্ছেন রাধা, তোমার উরু দুটোই তো ভৈরব পাহাড়। ঝাঁপ দিতে হয় তো সেখানেই দেব। এসো, তোমার ওই দুটো ‘কুচকুম্ভ’ গলায় বেঁধে তোমারই ‘লাবণ্য গঙ্গাজলে’ ডুব দিই। তবে কেসটা কিন্তু শেষ অবধি স্রেফ টন্ট-টিটকিরি, ঠাট্টা-ইয়ার্কি থাকে না। কৃষ্ণ রোজ-রোজ রাধার পথ আটকে তাঁকে ভোগ করতে চান। রাধা রোজ-রোজই তাঁকে এ-কথা সে-কথা বলে ফিরিয়ে দেন। নৌকাখণ্ড-য় কামুক কৃষ্ণ তাই রাধাকে ভুলিয়েভালিয়ে নৌকায় তোলেন। তার পর মাঝ-যমুনায় নিয়ে গিয়ে রাধার জামাকাপড়, গলার হার, মাথার মালা ছিঁড়েটিড়ে যেটা করেন, সেটাকে শ্লীলতাহানি বললে কিছুই বলা হবে না। ওটা রেপ-ই। আর ওই ‘ধর্ষণলীলা’র পরেই রাধার মন কৃষ্ণপ্রেমে একেবারে উথলে ওঠে। গুন্ডা-বদমাশ-তোলাবাজ কান্হাইয়াকে তিনি তখন ক্ষণে ক্ষণে চোখে হারান। কালার বাঁশি শুনলেই কাম-জ্বরে কাঁপতে থাকেন।
সব মিলিয়ে প্রমাণ হয়ে যায়, পরকীয়ার ইচ্ছেটা রাধার ষোল আনাই ছিল। কিন্তু একটু থতমত খাচ্ছিলেন! কৃষ্ণ নৌকায় তুলে যেই জোর করে শরীরের আড় ভেঙে দিলেন, অমনি লজ্জা-টজ্জা সব ফরসা! এই কৃষ্ণলীলাই তাই ভারতীয় পুরুষের প্রেমের পাঠশালা। কৃষ্ণই শেখান, প্রেমের সময় মেয়েদের ‘স্পেস’ দিতে গেলেই মুশকিল। ন্যাকা-নখরাবাজ মেয়েগুলো তখন গুচ্ছের বখেড়া খাড়া করে দেবে। তার চেয়ে সোজাসুজি সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াও। হাত চেপে ধরো। দরকার হলে আলতো মুচড়েও দাও! আঁচল ধরে টানো। জোর খাটাও। পারলে তুলে নিয়ে চলে যাও। দেখবে, ‘ছোরি পট্ গয়ি’! ‘বেতাব’-এ সানি দেওল কী করলেন? বড়লোকের দেমাকি মেয়ে অমৃতা সিংহ বহুত অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছিলেন! সানি খপ করে চুলের মুঠিটা ধরে ঝপ করে অমৃতার মুখটা কাছে টেনে এনেই ঠোঁটের ভিতর ঠোঁট ডুবিয়ে উ-উ-ম করে একটা ল-ম্বা কি-ই-ই-স! ব্যস, মেয়ে ফিট!
সুধীর কক্করের মতো মনোবিশ্লেষকরা অবশ্য বলিউডের প্রেমিকদের তিন রকম টাইপে ফেলেন। একটা হল ‘মজনু’-প্রেমিক। তাঁদের গাল-ভর্তি দাড়ি, লিভার-ভর্তি অ্যালকোহল, চোখ-ভরা জল, বুক-ভরা বিরহ। এঁরা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদেন, ফোঁসফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর হা-পারো হা-লায়লা বলে ঘন ঘন মুচ্ছো যান। আর একটা টাইপ আছেন, ‘দিওয়ার’-এর অমিতাভ বচ্চন-লগ্নে যাঁদের জন্ম। এঁরা মহাভারতের কর্ণের মতো ‘লাওয়ারিস’, কর্ণের মতোই মহাবীর হৃদয়বান, কর্ণের মতোই ফাটা-কপাল, আবার কর্ণের মতোই ‘ব্যাড বয়’। এই ‘গুড-ব্যাড’ নায়কদেরও জীবনে প্রেম আসে। তবে সেই প্রেমিকারা সরল-অপাপবিদ্ধা-গুডিগুডি-লাজুক রাধা-টাইপ নন। তাঁরা একলা বারে বসে মদ খান, নায়কদের লাইটারে নিজের সিগারেট জ্বালান এবং উদাসীন ইন্ট্রোভার্ট নায়কের অন্দরের চাপা যন্ত্রণা শেয়ার করতে পারেন। কিন্তু বলিউড-প্রেমিকদের যে টাইপটা সব সময় সুপারহিট, সেটা কৃষ্ণ-টাইপ। দেব আনন্দ থেকে শাম্মি কপূর, জিতেন্দ্র থেকে অক্ষয় কুমার এঁরা পর্দার রেগুলার কৃষ্ণ অবতার। এঁরা ডানপিটে, বিচ্ছু, বদমায়েশি বুদ্ধির রাজা, নায়িকাদের জ্বালাতনের একশা করেন এবং এঁদের লজ্জা-শরমের বালাই নেই। যতই তুমি নাকের ডগায়, মুখের ওপর দুমদাম খটাস করে জানালা-দরজা বন্ধ করে দাও, তাও এঁরা নায়িকার পিছু পিছু গেয়েই যাবেন ‘পল ভর কে লিয়ে কোই হামে প্যার কর লে, ঝুটা হি সহি’! তবে প্রেম নিবেদনের ভাষা সব সময় এতটা নির্দোষ-শাকাহারী থাকে না। আশি-নব্বইয়ের দশের গানের কথায় তো প্রায়ই ডাব্ল-মিনিং’ওলা প্যাঁজ-রসুনের গন্ধ ম-ম করত, তার ওপরে এই সব ফিল্মি-রোমিয়োরা আচমকা কলেজের গেটে, সব্জিবাজারে, ট্রেনের কামরায় কিংবা বাসের জানালায় হাজির হয়ে যে-সব কসরত শুরু করে দেন, নায়িকাদের শরীরের এমন সব বিপজ্জনক আনাচে-কানাচে চলে যান যে সিনেমার পর্দা না হলে তাঁদের নামে অবশ্যই যৌন হেনস্থার কেস ঠুকে দেওয়া যেত। আরাধনা-য় রাজেশ খন্নার ডায়ালগটা তো ইভ-টিজারদের কোটেশন-বইয়ের পয়লা নম্বরে থাকতে পারে মেয়েদের রাগাতে পারলেই প্রেমের আসলি মজা! জিতেন্দ্রর তো ইন্ডাস্ট্রিতে আদরের ডাকনামই ছিল ‘জ্যাক ইন দ্য বক্স’! আর প্রেমের গানের দৃশ্যগুলোয় শাম্মি কপূর গোটা শরীরটাকে যে ভাবে ঝাঁকাতেন-নাচাতেন-বাঁকাতেন, দেখে সুধীর কক্করের মনে হয়েছে, নায়ক নিজেই যেন আস্ত একটা পুরুষাঙ্গ তাঁর সলিড মর্দাঙ্গির তাপে আর তাকতে উদাসিনী নায়িকার বরফ-ঠান্ডা প্রতিরোধ আর প্রত্যাখ্যান ফাটিয়ে-গলিয়ে জল করে দিচ্ছেন! |
|
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কৃষ্ণ-অবতারের ইমেজ এতটাই অপ্রতিরোধ্য যে, পর্দায় অমন গম্ভীর-বিষণ্ণ-অভিমানী, শহিদ কর্ণ-টাইপ অমিতাভ বচ্চনকেও ‘খাতুন কি খিদমত মে’ গোঁফ-আঁচিল লাগিয়ে, লুঙ্গির ওপর বেল্ট বেঁধে, হায়দরাবাদি-রোমিয়ো সেজে হেমা মালিনীর সঙ্গে রঙ্গ করতে হয়েছে। আর, ‘গিরেফতার’-এ তো নায়িকার মন ভেজাতে তিনি একেবারে বৃন্দাবনের ছত্রধারী কানহাইয়া। পঞ্জাব কা পুত্তর, জাঠ-সিংহ ধর্মেন্দ্রও ‘তেরা পিছা না ম্যায় ছোড়ুঙ্গা’ বলে হেলিকপ্টারে চেপে আকাশে নায়িকার পিছু নিয়েছেন। ও দিকে রাজ কপূর আকাশে না উড়লেও গাছে চড়েছেন। ‘সঙ্গম’-এ তিনি পুরোদস্তুর ‘বস্ত্রহরণখণ্ড’-র কেষ্টঠাকুর। গোপিনীদের বদলে এখানে তিনি নায়িকা বৈজয়ন্তীমালার কস্টিউম হাতিয়েছেন। তার কারণ, তিনি কখন থেকে জানতে চাইছেন ‘বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহি’, কিন্তু রাধা-বৈজয়ন্তী কিছুতেই পাকা কথাটি দিচ্ছেন না! সিধে আঙুলে ঘি উঠছে না দেখেই রাজের ওই কৃষ্ণ-স্ট্র্যাটেজি! দ্বাপরে গোপ-বালিকারা নগ্ন দেহেই কিষেণজির সামনে হাত জোড় করে হাজির হয়েছিলেন। ‘দৈনিক মথুরা’ বা ‘বৃন্দাবন সংবাদ’-এর পেজ থ্রি-তে কোনও ছবি যায়নি। কিন্তু কলিযুগের ভারতে সেন্সর বোর্ড নামে একটা বস্তু আছে। তাই, বৈজয়ন্তীমালা আগুন-রঙা এক সুইম-স্যুট থেকে জল ঝরাতে ঝরাতে রাজের সামনে পড়েন। তাঁকে শেষ অবধি মেনে নিতেই হয় ‘সঙ্গম হোগা হোগা হোগা’। ব্যস, রাজের অ্যাডভেঞ্চার শেষ তাঁর কৃষ্ণ-ইগো ভরপুর তৃপ্ত। নায়িকা ‘মান গয়ি’! প্রেমের প্রেশার গেম-এ নায়িকাকে প্রথম রাউন্ডে হার মানানো মানেই রোম্যান্স-সাম্রাজ্যের অর্ধেক ফতেহ্! বাকি অর্ধেকটা তো আদরের নৌকো চেপে সোহাগের যমুনায় ভাসতে ভাসতে আপনা-আপনিই দখলে চলে আসবে।
আসলে বৃন্দাবনের রঙ্গিলা রংবাজ কৃষ্ণ থেকে এ-পাড়া ও-পাড়ার গলির মোড়ের বাইকওয়ালা কিষেণ-কান্হাইয়া, এরা সব্বাই কমবেশি নার্সিসিস্ট। নিজের রূপের-গুণের প্রেমে বুঁদ! তাই কোনও মেয়েকে দেখে যখন এদের হৃদয়ে কুছ কুছ হোতা হ্যায়, তখন এরা ধরেই নেয়, ও-দিকের মেয়েটা তাদের মতো ছেলেকে ‘না’ বলতেই পারে না! মেয়েটার ‘নাঃ’ কিংবা ‘যাঃ’-কেও তারা তাই ‘হ্যাঁ’ ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপত্তির তোয়াক্কা না করে ওই ঝাঁপিয়ে পড়াটাই পৌরুষ ও প্রেমের তীব্রতার মাপকাঠি। এখন সে-মেয়ে যদি ভয়ে বা ভক্তিতে বলে দেয়, হ্যাঁ, সঙ্গম হবে-হবে-হবে, তো ঠিক আছে; তা না হলেই মেয়ের মুখে অ্যাসিড, গলায় ক্ষুর কিংবা বিয়ের আসরে ঢুকে ‘প্রেমিকা’র হবু বরের খুলিতে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুড়ুম! সুতরাং, মানো বা না-মানো, আমিই তোমার ভ্যালেন্টাইন নখরা করলেই পার্ক স্ট্রিট বানিয়ে দেব। তখন সুপ্রিম কোর্টে দৌড়েও কূল পাবে না।
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|