প্রবন্ধ...
‘ইন্ডিয়া, বাপ রে!’
দিল্লির তরুণীকে ধর্ষণ আর তাঁর মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনাকে এখন একটুও অত্যুক্তি না করে ঐতিহাসিক বলা যায়। বোঝা গিয়েছে, দেশে ও বিদেশে সর্বত্র এখনও শুভবুদ্ধির মানুষ আছেন, সহমর্মিতা বিরল হয়ে যায়নি এখনও। ক্ষমতার রক্তচোখকে ভয় না করে, শারীরিক আঘাত সহ্য করেও, প্রতিবাদী মানুষ যে ভাবে অনমনীয় সরকারকে বাধ্য করেছেন অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারে, ধর্ষকদের নজরকাড়া শাস্তির আইন প্রণয়নে, তা অভূতপূর্ব। এর দরকারও ছিল।
কিন্তু এই সুযোগে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম, বিশেষত ইংল্যান্ড আমেরিকার নানা পত্রপত্রিকা সম্পাদকীয় নিবন্ধে, মতামতের পাতায় যে ভাবে ভারতকে ধারাবাহিক ধোলাই দিয়েছে, এ দেশের পুরুষদের হিংস্র প্রাণী হিসেবে চালাতে চেয়েছে, প্রচ্ছন্ন বা অ-প্রচ্ছন্ন প্রতিতুলনায় মহান করে দেখাতে চেয়েছে তাদের দেশের পুরুষকে, সেটাও নজর করবার মতো। একটি মার্কিন সংবাদপত্র জ্ঞান দিয়েছে, ‘...ভারতের এই (ধর্ষণ) সংস্কৃতি বদলানো উচিত...’। ব্রিটেনের এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বলছে, ‘ভারত চেষ্টা করছে তার রেপ-সংস্কৃতি ছেড়ে এগিয়ে যেতে’। সে দেশের প্রথম সারির এক টেলিভিশন সংস্থা লাগাতার উপদেশ বর্ষণ করছে। ‘এই অপরাধ জ্বলজ্বল করে দেখাচ্ছে ভারতে যৌন-নির্যাতনের প্রাবল্যটিকে’, বলে দিয়েছে একটি ব্রিটিশ কাগজ। আমেরিকার একটি পত্রিকা দুঃখ করেছে: ইন্ডিয়াতে মাত্র এক চতুর্থাংশের কিছু বেশি ধর্ষণ-অভিযুক্তের শাস্তি হয়। সব সংবাদমাধ্যমের এক রা: ধর্ষণ ব্যাপারটা ইন্ডিয়ার সংস্কৃতি। ইংল্যান্ডের একটি দৈনিক পত্রিকার এক নাট্যসমালোচক তো ভারতের পুরুষদের মনে করেন, ‘খুনি, হিংস্র হায়নার মতো’। তাঁর যে সব জাতভাই এ দেশে বেড়াতে এসে হোটেলের অভ্যর্থনায় কপালে চন্দনতিলক, গলায় গাঁদাফুলের মালা ঝুলিয়ে, ক্লিক-ক্লিক ছবি তোলায় বিভোর হয়ে পড়েন অথবা কোনও আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে কৌতূহলী হন, তাঁদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, ‘দিল্লির বাস-রেপ ঘটনা নিশ্চয় ভারতকে নিয়ে আমাদের অযথা ভাবালুতাকে চুরমার করবে’।
তাঁর লেখার নিহিতার্থ: ভ্রাতা এবং ভগ্নীরা, তোমরা যারা বলিউডের সিনেমায় দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন দেখে ভাবো, এই হল ভারতের চেহারা, ভুল করছ। অত মুক্তকচ্ছ হয়ে ও দেশে যেয়ো না।
এ বার কিছু তথ্য পরিসংখ্যান। প্রথমে চলুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্য ফেডারাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফ বি আই-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১-র আমেরিকাতে ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় ৮৪,০০০। সে দেশে ধর্ষণ-অভিযুক্তের চব্বিশ শতাংশকে পুলিশ গ্রেফতারই করতে পারে না, সাজা দেওয়া তো তার পরের কথা। আর ব্রিটেন? সে দেশের স্বরাষ্ট্র দফতরের ২০১০-২০১১-র তথ্য আর ব্রিটিশ ক্রাইম রিভিউ, দু’টি দলিলই বলছে, দেশে প্রতি বছর ৮০,০০০ মহিলা ধর্ষিত হন এবং যৌন হেনস্থার শিকার হন প্রায় চার লক্ষ মহিলা। একটি হিসাব অনুযায়ী, ব্রিটেনে অভিযুক্ত ধর্ষকের মাত্র ৬.৫ শতাংশের শাস্তি হয়।
পাশে রাখুন ভারতকে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান: এ দেশে ২০১০-২০১১ সালে সর্বমোট ধর্ষণের অভিযোগ: ২২,১২৭। যদি অনুপাত দেখি? ১২০ কোটির ভারতে ধর্ষণের অভিযোগ বছরে ২২ হাজার, ৬ কোটির দেশ ইংল্যান্ড আর ৩১ কোটির দেশ আমেরিকায় তা যথাক্রমে ৮০ ও ৮৪ হাজার।
দিল্লির ঘটনায় যাঁরা বলছেন এ দেশের পথেঘাটে সব নেকড়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাঁরা কি ভুলে গিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো’র স্টুবেনভিল-এর সেই ষোড়শীকে? যাকে নাকি হাইস্কুলের ফুটবল দলের ছেলেরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। জোর করে মদ খাওয়ায়। তার অচেতন দেহটিকে একের পর এক ধর্ষণ করে। ঘটনার অব্যবহিত পরে কিচ্ছুটি হয়নি। একেবারে কিছুই হত না, যদি না আলেকজান্দ্রিয়া গোদার নামে এক ভদ্রলোক তাঁর ব্লগে এই ঘটনার উল্লেখ করে ধিক্কার জানাতেন। এর পরে, এই কিছু কাল আগে, একটি বড় কাগজ হঠাৎ জেগে উঠে এই বিষয়ে কয়েকটি খবর, নিবন্ধ ছাপে। অর্থাৎ ওই ঘটনার চার মাস পরে তা ওই দেশের মানুষের গোচরে এল।
১৯৯৯ সালের কথা। ইউরোপীয় সভ্যতার পীঠস্থান ফ্রান্সে নিনা আর স্টেফানি নামের দুই নাবালিকা ছ’মাস ধরে প্রায় প্রতিদিন ধর্ষিত হয়। একদল তরুণ নিয়ম করে রোজ আসছে, এক জনের কাজ শেষ হওয়া অবধি অন্য জন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে, তার পর অন্য জন। তিন সপ্তাহের বিচারে চোদ্দো জন অভিযুক্তের দশ জন বেকসুর খালাস, বাকি চার জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাজা হয় এক বছরের কারাবাস! সেন্ট্রাল ম্যাঞ্চেস্টারের এক বছর আগের ঘটনাটিও ভোলা উচিত নয়। মহিলাটিকে ধর্ষণ করে ফেলে চলে যায় এক তরুণ। অবমানিত তিনি আহত হয়ে পড়ে ভূমিশয্যায়। এক পথচারীর আবির্ভাব। মহিলা ভাবেন এই বার তিনি সাহায্য পাবেন, সহমর্মিতা পাবেন। কিন্তু হায়! ওই পথচারীও তাঁকে বলাৎকার করে।
একটু অন্য দিক থেকেও দেখা যেতে পারে ব্যাপারটা। অ্যামেনস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বছর আগের এক সমীক্ষা বলছে, তিরিশ শতাংশের বেশি ইংল্যান্ডবাসী মনে করে, ধর্ষণের আংশিক অথবা পূর্ণ দায় মেয়েদের দায়ী তার চটুল হাবভাব, তার পোশাক পরিচ্ছদ। মাস দুয়েক আগে ইংল্যান্ডের এক বিচারকও এক ধর্ষককে বলছেন, মহিলা বাড়াবাড়ি করেছিলেন, প্রচুর মদ্যপান করেছিলেন, ড্রাগও নিয়েছিলেন, সর্বোপরি তাঁর দুর্ভাগ্য যে উনি তোমার খপ্পরে পড়েছিলেন।
একটা দেশে অন্যায় হয় বলে সে দেশের মানুষ অন্য দেশে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবেন না, এটাও কোনও যুক্তি নয়। কিন্তু সেই বিবাদী ভাষ্যে কিছু ঘটনা (বা এমনকী অনেক ঘটনা) দিয়ে একটা গোটা দেশের ‘চরিত্র’ দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, তাতে সত্যের হানি ঘটে, সমালোচনার মর্যাদাও লাঞ্ছিত হয়। আর, সততার খাতিরে, নিজের ঘরের অনুরূপ অনাচারটিকেও ধিক্কার দেওয়া দরকার। তখনই সে প্রতিবাক্য ভারসাম্য বজায় রেখে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
আমেরিকা-ইংল্যান্ডে বলাৎকারের বিপুল সংখ্যা দেখে ধর্ষণ সমস্যা-পীড়িত ভারতের যেমন উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই, পশ্চিম দুনিয়াকেও তেমনই বুঝতে হবে, ক্রমবর্ধমান ‘রেপ’ শুধু ভারতের সমস্যা নয়। এই বোধটা সমস্যার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্যও আবশ্যক। যে রোগের নিরাময় মিলিত ভাবনার দাবি রাখে, তার ক্ষেত্রে অন্যকে দুষে নিজের ব্যাপারে চোখ বুজে থাকা খাটের তলায় টাইম বোমার টিকটিক ভুলে থাকার নামান্তর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.