উত্তর কোরিয়ার সরকারি ওয়েবসাইট হইতে ইউটিউবে ভিডিয়ো প্রকাশিত হইল: উত্তর কোরীয় যুবক স্বপ্ন দেখিতেছে, সে মহাকাশযানে চড়িয়া বিশ্ব প্রদক্ষিণরত। নানা দৃশ্য সে দেখিতে পায়, ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া-ও (উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়া), তাহার পর অকস্মাৎ দেখা যায় নিউ ইয়র্কের ন্যায় একটি শহর (মার্কিন পতাকা দ্বারা আবৃত) দাউদাউ জ্বলিতেছে ও বহু মিসাইল তাহার উপর বর্ষিত হইতেছে। লেখা ফুটিয়া উঠে: ‘আমেরিকার কোনও স্থানে ধোঁয়ার কালো মেঘ উঠিতেছে’ এবং তাহার পরে: ‘মনে হয় বদমায়েশির আঁতুড়ঘরটি নিজের লাগানো আগুনে এই বার নিজেই পুড়িতেছে’। একটি দেশের বিরুদ্ধে অন্য একটি দেশের শত্রুতা, দ্বেষ, এমনকী ক্ষতিকামনা থাকিবেই, উহা সম্প্রদায়-মধ্যে ও ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির সম্পর্কেও বিলক্ষণ বর্তমান, উহার অনস্তিত্ব কল্পনা নিতান্ত ইউটোপীয় বাতুলতা, কিন্তু প্রকাশ্যে বুক বাজাইয়া নিজের ওই প্রবৃত্তিগুলির প্রচার আধুনিক কালে কিছু সময় পূর্বেও সভ্যতার পরিপন্থী বলিয়া বিবেচিত হইত। সভ্যতা কেবল এইটুকুই বলিয়াছে, মানুষ যেন পোশাক পরিয়া থাকে। মানুষ তাহার ভিতর হইতে জঘন্য প্রবৃত্তিগুলি সম্পূর্ণ ছাঁটিয়া ফেলিতে পারিলে তো অতি উত্তম, সত্য বলিতে কী, তাহার পথেই মানবের যাত্রা, কিন্তু তাহা না পারিলেও সে যেন কদর্য প্রবণতাগুলি লুকাইয়া রাখে, কাঁচা ইচ্ছাগুলিকে ঔচিত্য দিয়া সাঁতলাইয়া লয়। সেই জন্যই আমরা চরম শত্রুর সহিতও মঞ্চে অবস্থানের সময় তাহার টুঁটি চাপিয়া নাচি না, গালি দিই না, যুক্তি দিয়া তাহার উক্তির বিরোধিতার চেষ্টা করি। এই মৃদুতার আবরণখানি স্বশৃঙ্খলার ফলে বিছাইয়া আছে বলিয়াই অপছন্দের আত্মীয় বেড়াইতে আসিলেও গৃহস্থ মিষ্টান্ন নিবেদন করে, উহারা চলিয়া গেলে তবে মুণ্ডপাত করে। যদিও ইদানীং সর্বত্রই এই শিষ্টতাকে ভীরুতা মনে করিয়া, মহা স্পর্ধায় তাহা ছিন্ন করিয়া, রাজনৈতিক শত্রুকে অকথ্য ভাষায় তুলোধোনা করিবার চল দেখা যাইতেছে। বহু সংগঠনের পক্ষ হইতে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য, উদ্ধত হুমকি, বাহুবলের আস্ফালন অতিশয় গর্বের বিষয় হইয়া অশুভ রশ্মি বিকিরণ করিতেছে। হয়তো ইহা মন্দ গতিক নহে। হয়তো সভ্যতার এই বহিরঙ্গের সংযমরক্ষা এক কুশিক্ষা। মানুষ এই আরোপিত নিষেধগুলি ত্যাগ করিয়া যখনই ক্রোধ বা ক্ষোভে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া ইতরের ন্যায় স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার করিতেছে, তখনই সে স্বরূপটি প্রকাশ করিতেছে, নিজ সত্যকে স্পর্শ করিতেছে। তাহার মধ্যে ভণ্ডামি থাকিতেছে না। যাহাকে সহ্য করিতে পারি না তাহাকে বৈঠকখানায় না বসাইয়া ঘাড়ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিবার মধ্যেই হয়তো অকৃত্রিম আন্তরিক সারল্য বিরাজমান, কেতাবি সমীচীনতা সেই যাথার্থ্যকে স্পর্শ করিতে অপারগ। ইহা মানিয়া নিলে অবশ্য দাঙ্গা থামানো যাইবে না, চুলোচুলির উৎসব লাগিয়া যাইবে। ভারতের রিয়েলিটি শো-তে পাকিস্তানের প্রতি আত্যন্তিক ঘৃণা জানাইবার উত্তাল প্রতিযোগিতা শুরু হইবে। কিন্তু এত দিন ধরিয়া মানুষ জন্তুদের ঊর্ধ্বে উঠিবার অভিপ্রায়ে নিজ অন্তরে উদ্ভট মুখোশ সাঁটিবার পর হয়তো তাহার দাগড়া হইয়া ছাল উঠিয়া গিয়াছে, মিথ্যার খোস গজাইয়াছে। গরল উঠিবার ভয়ে অমৃতমন্থন থামানো যায় না, সমস্যা দেখা দিবে বলিয়া কাহারও প্রকৃত স্বাধীনতা আবিষ্কারকে ক্ষুণ্ণ করা যায় না। সত্য কঠিন, তথাপি তাহাকে ভালবাসিতে হইবে, তাহার আঘাতে মাথা ফাটিলে রক্তকে বৃহত্তর লাভের জয়তিলক ভাবিতে হইবে। পাল্টা সত্য সপাটে নিক্ষেপণের ফ্যান্টাসি পূরণ করিতে ইউটিউব তো রহিলই! |