দিন বদলেছে, দেখা নেই তাই কালকূটের নায়িকার
শ্যামাকে এ বার খুঁজে পেলাম না। আগামী রবিবার মৌনী অমাবস্যার ‘শাহি স্নান’ উপলক্ষে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভে ক্রমে মানুষের ঢল নেমেছে। মাথায় বোঁচকা নিয়ে দেহাতি নারী, টয়োটা চড়া শহুরে পরিবার... কেউ বাকি নেই। যুবক-যুবতী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সকলে এগিয়ে চলেছেন গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমের দিকে। কোথাও রণ-পা চড়ে বালক সন্ন্যাসী বিলি করছে তাদের আশ্রমের বুকলেট, কোথাও বা কোনও বৃদ্ধ খুঁজছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। ‘বলেছিল, সতেরো নম্বর পুল পেরিয়ে ডান দিকে। ছতরপুর জেলার গিরিজির আশ্রম, বাবুজি?’
এই ভিড়েই লুকিয়ে আছে সে? রাগি, দেহাতি বৃদ্ধের তিন নম্বর বউ। তবু হারায়নি যৌবনের উচ্ছ্বাস, মেলার পথে অচেনা পুরুষের সঙ্গে হাসির ঝিলিকে, চোরা চাউনিতে কথা বলে। কালকূটের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ উপন্যাসের নায়িকা। ১৯৫৪ সালে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ থেকে ফিরে গিয়ে সেই উপন্যাস লিখেছিলেন কালকূট। বইমেলার শহর খেয়াল করেনি, এ বারেই সেই কালজয়ী উপন্যাস পা দিল ষাট বছরের চৌকাঠে।
কুম্ভমেলায় শনিবার। প্রশান্ত মল্লিকের তোলা ছবি।
ছয় দশকের বদল কি কম? কালকূটের বর্ণনায় ছিল, বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা ইলাহাবাদ স্টেশন। সেখানেই কলেরা ইঞ্জেকশন দেওয়ার ছাউনি। এখন আর সেই ব্যারিকেড নেই, কলেরার ইঞ্জেকশনও দূর অস্ত! স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেই রিক্সা, অটোরিক্সা। চলছে ‘মহাকুম্ভ ২০১৩’ লেখা শাট্ল বাস। গতিই এখন মন্ত্র। কালকূটের উপন্যাসে হাওড়া থেকে ট্রেন ছেড়ে চিত্তরঞ্জন, মোকামা হয়ে বিকেল চারটেয় ইলাহাবাদ স্টেশন। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী জানাচ্ছেন, সেই সময় হাওড়া-ইলাহাবাদ পথে মাত্র চারটি ট্রেন ছিল। তুফান এক্সপ্রেস, দিল্লি-কালকা মেল, মুম্বই মেল, ৩৯ আপ জনতা এক্সপ্রেস ও ১১ আপ দিল্লি এক্সপ্রেস। শেষ দুটি ট্রেন হাওড়া থেকে ছেড়ে যথাক্রমে বিকেল ৪টা ৫১ ও দুপুর ৩টেয় ইলাহাবাদ ঢুকত। ১১ আপ এখন আর হাওড়া থেকে ছাড়ে না, কলকাতা স্টেশনে স্থানান্তরিত হয়েছে সে। তার নাম আজ লালকেল্লা এক্সপ্রেস। মেলার বিস্তার বেড়েছে বহু গুণ। ১৯৫৪ সালে মেলা থেকে ফিরে ৭ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি কালকূট আনন্দবাজার পত্রিকায় দুই কিস্তিতে, স্বনামে এক প্রতিবেদন লেখেন। ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড হইতে ঝুসি ও সঙ্গম হইতে রেলওয়ে সেতু অবধি, বিস্তীর্ণ কয়েক মাইল জুড়িয়া মেলা,’ লিখছেন সমরেশ বসু। এখন মেলা ঝুসি ছাড়িয়ে নৈনির দিকে আরেলঘাট অবধি জমজমাট। বালির চরে প্রায় ২১ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে তাঁবুর শহর, ২২ হাজার বাতিস্তম্ভ। যমুনার উপর নতুন সেতু, পারাপারের জন্য ভেলার ওপর ১৮টি পন্টুন ব্রিজ।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের হিসাব, তৈরি হয়েছে ১৫৬ কিমি রাস্তা। বৈদুাতিক লাইন যা পাতা হয়েছে, একসঙ্গে মাপলে ৭৭০ কিমি হবে। সঙ্গে পানীয় জল সরবরাহের জন্য ৫৫০কিমি পাইপলাইন। দুনিয়ার বৃহত্তম ধর্মীয় মেলা নয়, দেশের উন্নয়নের শো-কেস!
কুম্ভ যে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে কত ভাবে ছড়িয়ে আছে! ’৫৪ সালের প্রয়াগেই শিষ্যা ইন্দিরা দেবীকে নিয়ে এসেছিলেন গায়ক ও সাধক দিলীপকুমার রায়। তারও আগে, শ্যামাচরণ লাহিড়ি, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী থেকে আনন্দময়ী মা। ’৭৭ সালের পূর্ণকুম্ভে এসেই নবনীতা দেবসেনের ভ্রমণকাহিনি ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’। কালকূট পৌষসংক্রান্তির স্নানে প্রয়াগে এসেছিলেন, নবনীতা মাঘ মাসের মৌনী অমাবস্যায়। কালকূট, নবনীতারা সে দিনের!
ইতিহাসের হিসেব, ১৫১৪ সালের পূর্ণকুম্ভে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য। হিসেবটি নিয়ে দ্বিমত আছে। কিন্তু দ্বিমত নেই বাঙালির ‘কুম্ভ সাহিত্য’ নিয়ে। প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ থেকে ফিরে বাংলা ১২৯৯ সালে ‘ধর্মপ্রচারক’ কাগজে কলকাতার এক বাসিন্দা লিখছেন, ‘এই মেলায় সাধুদিগের প্রতাপ রাজারাজড়াদের থেকেও অধিক বোধ হইল।’ বাংলা ১৩০০ সালে প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য বইয়েও কুম্ভে ভিড়, নাগা সন্ন্যাসীদের মিছিলের কথা নেই। উল্টে কোন কোন সাধু মেলায় এসেছেন, তাঁদের বর্ণনা।
কুম্ভমেলা নিছক মেলা নয়। বারো বছর অন্তর এক বিশেষ পরিসর, যেখানে সাধু ও গৃহীদের মধ্যে আলোচনা চলে। সাধুরা অন্য সাধুদের সঙ্গে নিজেদের ধর্মপথ আলোচনা করেন। এ বার কোনও কোনও সাধু রাষ্ট্রের রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। বাবা রামদেবের ব্যানার, ‘গো, গঙ্গা, ধর্ম, রাষ্ট্র কি রক্ষা।’
কখনও সাধুদর্শন, কখনও ভিড়দর্শন! বাংলা ১৩৩০ সালে বিনয়ভূষণ দত্ত প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ থেকে ফিরে তাঁর বইয়ে লিখছেন, ‘এই দুর্দশার দিনেও ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মমেলার গৌরব আপনার বক্ষে ধারণ করিয়া আছে।’ মানুষের ভিড় ও জাতীয়তাবাদ মিলেমিশে একাকার। স্বাধীনতার সাত বছর পরে তাঁর উপন্যাসে কালকূটও এই জাতীয়তাবাদকেই বড় করে দেখান, ‘পথের দু’ ধারে চলছে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বোম্বাই, গুজরাট, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ। কী বিচিত্র তার রূপ!’ রায়পুরের স্টেশনারি দোকানের মালিক অশোক দত্ত পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হল কল্পবাসীদের তাঁবুতে। কল্পবাস মানে, পৌষের পূর্ণিমা থেকে মাঘী পূর্ণিমা অবধি এক মাস সস্ত্রীক তাঁবুতে থেকে বিচালিতে শোওয়া। ভোর চারটেয় গঙ্গাস্নান সেরে গঙ্গাপুজো, দানদক্ষিণা সেরে প্রবচন ও ধর্মকথা শোনা। দুপুরে স্বপাক আহার। ওই এক বেলাই রান্না-করা খাবার খাওয়া যাবে। মাঘী পূর্ণিমার শেষে ফের সংসারী জীবনে ফিরে যাওয়া। অশোকবাবুর এক পুত্র শিক্ষক, অন্য জন ডাক্তার। নিজেরও খেতি-জমি আছে। ইচ্ছা হলে গৃহীদেরও এক মাস সন্ন্যাসজীবন, এটিই কল্পবাস। তবে এখন আর উপন্যাসের মতো কল্পবাসী স্বামী-স্ত্রী অন্যদের দৃষ্টির আড়ালে, বালির চড়ায় থাকেন বা ভোরের অন্ধকারে নগ্ন হয়ে স্নান সারেন এমন নয়। এখন এক-দেড়শো কল্পবাসী তাঁবু ভাড়া নিয়ে একত্র থাকেন, এমনকী ইন্টারনেটেও কল্পবাসের তাঁবু বুক করা যায়।
নিজেকে বদলাতে বদলাতে এ ভাবেই এগিয়ে চলেছে সে। এভারচেঞ্জিং, এভারলাস্টিং কুম্ভমেলা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.