বারবারই বলতেন, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে
বিতর্ক আর বেশ কিছু প্রশ্ন এত দিন ঘিরে ছিল আফজল গুরুকে। ফাঁসি কাঠে শেষ হয়ে গিয়েছে জীবন। তবু মিলছে না উত্তর।
পুলিশের দাবি ছিল, কাশ্মীরের বাসিন্দা আফজল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের সদস্য। ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থানে হামলা চালানোর ছক কষেছেন। কিন্তু তিহাড় জেলে বসে আফজল বারবার দাবি করে গিয়েছেন, তিনি নির্দোষ। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তাঁর পরিবারকে খুন করার হুমকি দিয়ে জোর করে সাদা কাগজে তাঁকে সই করতে বাধ্য করেছে পুলিশ। কিন্তু জেলের চার দেওয়ালেই গুমরে মরেছে ফাঁসির অপেক্ষায় থাকা মানুষটির গলার স্বর।
একই দাবি করেছেন আফজলের স্ত্রী তবসুমও। জানিয়েছেন, কী ভাবে অত্যাচার করা হয়েছে তাঁর স্বামীর উপরে। তবসুম, যাঁর সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন সোপোরের এই বাসিন্দা। যেমন দেখেন আর পাঁচ জন মানুষ। কিন্তু সব কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের পরে।
আফজল গুরু আর আজমল কসাব। তিন মাসের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল দু’জনেরই। দু’জনেরই অপরাধ, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী। জঙ্গি কসাব হত্যালীলা চালিয়েছিল মুম্বইয়ে। খুন করেছিল শতাধিক মানুষকে। টিভিতে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র নিয়ে তাকে হামলা চালাতে দেখেছিল গোটা দেশ। কসাব নিজে স্বীকার করেছিল, সে আত্মঘাতী জঙ্গি। মারতে এবং মরতেই এসেছে ভিন্ দেশে।
আর আফজল? ২৭১ পাতার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সংসদ হামলার অন্যতম চক্রী আফজল। হামলা কার্যকর করার ক্ষেত্রেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় রাখা এবং বিস্ফোরক সরবরাহ করায় জরুরি ভূমিকা নিয়েছিলেন। শীর্ষ আদালত আফজলের নাশকতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই বলে মন্তব্য করেছিল।
তবু থামেনি বিতর্ক। আফজলের প্রাক্তন আইনজীবী কামিনী জয়সওয়াল এ দিনও দাবি করেছেন, শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে আফজলকে। আর আফজল নিজে বারংবার বলেছেন, বিপথে গিয়েছিলেন তিনি যৌবনে। ফিরেও এসেছিলেন স্বাভাবিক জীবনে। সংসদ হামলায় তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না।

আমি পারিনি, চাই আমার ছেলে ডাক্তার হোক
আফজল গুরু
(সাত বছর আগের এক সাক্ষাৎকারে)
তিহাড় জেলে বসে নিজের জীবনের কথা সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে বলে গিয়েছিলেন আফজল। সোপোরের এই তরুণ প্রথম জীবনে ছিলেন শ্রীনগরের ঝিলম ভ্যালি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরের বহু যুবকের মতো তিনিও আকৃষ্ট হন জেকেএলএফ-এর আন্দোলনের প্রতি। ছাড়তে হয় কলেজ। অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণও নেন। কিন্তু ভুল বুঝতে পারেন অচিরেই। কয়েক সপ্তাহ পরে কাশ্মীরে ফিরে এসে তিনি বিএসএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গি হিসেবে সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। নতুন জীবনের পথে পা বাড়ান আফজল। ১৯৯৭-এ কাশ্মীরে ওষুধ এবং চিকিৎসার যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করেন।
বিয়ে করেন তবসুমকে। আফজল তখন ২৮। তবসুম ১৮। চোখে সুখী জীবনের স্বপ্ন।
কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। আফজলের অভিযোগ, প্রায়ই রাষ্ট্রীয় রাইফেলস এবং এসটিএফ তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে হেনস্থা করত। তত দিনে আফজল এবং তবসুমের একটি ছেলে হয়েছে। উর্দু কবি মির্জা গালিবের নামে ছেলের নাম রাখেন গালিব। কিন্তু উত্তরোত্তর তাঁদের উপর অত্যাচার বাড়তে থাকে। যখনই কোনও জায়গায় জঙ্গি হানা ঘটত, তখনই আফজলের উপর অত্যাচার চালাত এসটিএফ। এর পরেই এক দিন রাষ্ট্রীয় রাইফেলের লোকজন আফজলকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। আফজলের দাবি, প্রচুর টাকা ঘুষ না দিলে তাকে সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। বীভৎস শারীরিক নির্যাতন চলে। তাঁকে এসটিএফ ক্যাম্পের শৌচালয়ও পরিষ্কার করতে হতো বলে অভিযোগ। আফজলের বয়ান অনুযায়ী, এই সব অত্যাচার চালানো হত ডিএসপি বিনয় গুপ্ত এবং দভিন্দর সিংহের তত্ত্বাবধানে। অবশেষে ঘুষ দিয়ে অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পান আফজল। ঘুষের জন্য আফজলকে নিজের স্কুটার এবং তবসুমকে তাঁর গয়না বেচতে হয়।
এর পরেও রেহাই মেলেনি। আফজলের আরও দাবি, দভিন্দর সিংহ তাঁকে জানান, হয়রানি থেকে পাকাপাকি বাঁচার জন্য এবং নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আফজলকে একটি ছোট কাজ করে দিতে হবে। কাজটি হল দিল্লিতে মহম্মদ নামে একটি লোকের জন্য বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আফজল মেনে নেন। মহম্মদ এবং আফজল দিল্লিতে থাকাকালীন প্রায়ই তাঁদের ফোন করতেন দভিন্দর। দিল্লিতে একটি গাড়ি কেনে মহম্মদ। তার পরে মহম্মদ একদিন তাঁকে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে বলে, আফজল চাইলে ঈদে কাশ্মীরে যেতে পারেন। আফজল ফিরে যান।
এর পরের ঘটনারও অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন আফজল। তাঁর দাবি, এক দিন শ্রীনগর থেকে সোপোরের বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁকে আচমকা গ্রেফতার করে পরিমপুরা থানার পুলিশ। এসটিএফ সদর দফতরে নিয়ে এসে তাঁর উপরে চলে নারকীয় অত্যাচার। তার পর আফজলকে আনা হয় দিল্লিতে। দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেলে নিয়ে এসে ফের অত্যাচার। তাঁকে বলা হয় তিনি নিজে, তাঁর তুতো ভাই শৌকত, শৌকতের স্ত্রী নভজোৎ এবং দিল্লির কলেজ শিক্ষক এস এ আর গিলানি সংসদ হামলার সঙ্গে জড়িত। মহম্মদের কথা খুলে বললেও আফজলকে বিশ্বাস করেনি পুলিশ। উল্টে আফজলের অভিযোগ, পুলিশ তাঁকে বাধ্য করেছিল সংবাদমাধ্যমের সামনে সংসদে হামলা চালানোর ঘটনা স্বীকার করার জন্য। আফজল জানান, তাঁর অন্য কিছু করার উপায় ছিল না। পুলিশ তাঁর পরিবারকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল। আফজল আরও জানিয়েছিলেন, সংবাদমাধ্যম গিলানি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, গিলানি নির্দোষ। এই কারণে সাংবাদিকদের সামনেই এসিপি রাজবীর সিংহ তাঁকে ধমক দিয়েছিলেন। আফজলের এই কথাটি প্রচার না করার জন্যও সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিলেন তিনি। আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন সব সময় আফজলকে আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রয়োজনীয় আইনজীবী দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ। আফজল তাই সংসদ হামলায় নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন, “এটাই কি গণতন্ত্রের স্বরূপ?”
২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার পর থেকে এতগুলো বছর ধরে সুতোয় ঝুলে থেকেছে আফজলের জীবন। পাকিস্তানে ভারতীয় চর সন্দেহে বন্দি সর্বজিৎ আর এখানে আফজল রাজনীতি আর কূটনীতির জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে তাঁদের ভাগ্য। হতাশ আফজল এক বার বলেওছিলেন, এর চেয়ে মৃত্যু ভাল। সেই মৃত্যুই দড়ির ফাঁস হয়ে নেমে এল এ বার। নির্জন সেলে বসে আফজল বলে গিয়েছিলেন, “স্বপ্ন ছিল বড় ডাক্তার হব। হতে পারিনি। আমার ছেলেটা যেন ডাক্তার হয়!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.