কার্ফুর মধ্যেই পথে নামল উপত্যকার মানুষ |
সাবির ইবন ইউসুফ • শ্রীনগর |
বেশ কয়েক মাস পরে শনিবারের ভোরটা অন্য রকম ভাবে শুরু হল কাশ্মীরের বাসিন্দাদের। রাস্তায় ভারী বুটের শব্দ। মাঝেমধ্যে ঘুরে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর গাড়ি। এবং জারি করা হয়েছে কার্ফু। উপত্যকার বাসিন্দাদের কাছে কার্ফু নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাতসকালে?
বেলা একটু বাড়তেই টিভি থেকে উধাও সংবাদ চ্যানেলগুলি। মোবাইলে কাজ করছে না ইন্টারনেট। কী হল, খুঁজতে গিয়েই জানা গেল, সকালে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে আফজল গুরুকে। দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। আর তার পরেই কার্ফু উপেক্ষা করে অনেক জায়গায় মানুষ নামলেন রাস্তায়। তার পরই সেই অশান্ত কাশ্মীরের চেনা ছবি। পুলিশ-নিরাপত্তা বাহিনী বনাম জনতা। কোথাও কাঁদানে গ্যাস-লাঠি, তো কোথাও শূন্যে গুলি। আহত হলেন অন্তত ৪০ জন। এবং ইঙ্গিত মিলল, আগামিকালও পথে নামতে পারে জনতা। |
|
আফজল গুরুর স্মৃতিতে বিশেষ প্রার্থনা। শ্রীনগরের কাছে। ছবি: রয়টার্স |
গোয়েন্দারা নিশ্চিত, এর পিছনে পাক-পন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলির মদত আছে পুরোদস্তুর। নিরাপত্তায় ঢিলে দিতে নারাজ প্রশাসন তাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফু জারি করেছে। এই অবস্থায় রাজ্যে শান্তি রাখার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। রাজ্যবাসীর উদ্দেশে আজ ওমর বলেন, “মানুষের মনে হয়তো কিছু ক্ষোভ আছে। এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক কারণে অনেকে ব্যবহার করতে পারেন। অনুরোধ, শান্ত থাকুন।”
কিন্তু শান্ত থাকেনি উপত্যকা।
সোপোরের সির দোয়াবগাহ গ্রামে আফজল গুরুর বাড়ি। তাই বিক্ষোভের মাত্রা সব চেয়ে বেশি ছিল সোপোর এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে। বহু বিক্ষোভকারী সেই গ্রামে ঢোকার চেষ্টাও করেন। বারামুল্লা-সহ উপত্যকার নানা জায়গায় বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে শূন্যে গুলি ছোড়ে পুলিশ। ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের সেল। বিক্ষোভকারী এবং পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন মোট ৩৬ জন। তাদের মধ্যে ২৩ জন পুলিশকর্মী। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অন্তত চার জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। |
|
ধর্নায় ইয়াসিন মালিক। ছবি: এএফপি |
ওমর জানান, শুক্রবার রাত আটটা নাগাদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোনে জানান যে, পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ ফাঁসি হবে আফজলের। তার পর থেকেই রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। শনিবার সকালে জম্মুতে চলে যান ওমর। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও করেন। আফজল গুরুর ফাঁসির খবর ছড়িয়ে পড়লে কাশ্মীর যে ফের অশান্ত হয়ে উঠবে, তা জানত প্রশাসন। তাই ভোর ৪টে থেকে শুরু হয়েছিল নানা এলাকায় পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ১০টি জেলায় জারি করা হয় কার্ফু!
আর গোটা ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন পর্যটকেরা। তিন দশকের অশান্তির মেঘ একটু সরতেই কাশ্মীরে ফের ঢল নেমেছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা ঘরবন্দি। হোটেল, হাউসবোটেই আটকে রয়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হাউসবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিলাল হান্ডু। শনিবার আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, “প্রচুর পর্যটক এসে রয়েছেন এখানে। তাঁদের অধিকাংশই এসেছেন বিদেশ থেকে। যত তাড়াতাড়ি শান্তি ফিরে আসে, তত ভাল।” |
|
আফজলের ফাঁসিতে ফের অশান্ত কাশ্মীর। গাছের গুঁড়ি ফেলে আটকানো
হয়েছে রাস্তা। শ্রীনগরের কাছে হারওয়ানে। ছবি: পি টি আই |
তাঁর বক্তব্য, একটা দিন এভাবে আটকে পড়ায় হয়তো অনেকের তেমন অসুবিধা হয়নি, কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে সমস্যা ক্রমশ বাড়বে। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক শেখ শওকত হুসেনের বক্তব্য, মকবুল বাটের যখন ফাঁসি হয়, তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে এখনকার অবস্থা হুবহু মিলে যাচ্ছে। সেই সময়ে বহু দিন পর্যন্ত বিক্ষোভ হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক হুসেন। এই অবস্থায় রাজ্যের সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, গত দু’বছরে যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছিল কাশ্মীরে, তা কি ফের ইতিহাস হতে চলেছে? না কি দ্রুত চেনা ছন্দে ফিরবে উপত্যকা?
|
|