|
|
|
|
দেশ জুড়ে জারি সতর্কতা |
কাশ্মীর নিয়ে চিন্তার মধ্যেই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কুম্ভ |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। দিল্লি হাইকোর্টের সামনে বিস্ফোরণ। নিহত ১৫ জন। তার পাঁচ গুণ মানুষ আহত। বিস্ফোরণের পরেই ই-মেল মারফত হুমকি এল, ‘আফজল গুরুর ফাঁসি অবিলম্বে বাতিল না হলে ভবিষ্যতে দেশের প্রধান প্রধান হাইকোর্টগুলিতে এবং সুপ্রিম কোর্টেও হামলা হবে।’
আজ সকালে তিহাড় জেলে আফজল গুরুর ফাঁসি এক ধাক্কায় ফিরিয়ে আনল দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণের দুঃস্বপ্ন। আফজলের ফাঁসির বদলা নিতে জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে, এই আশঙ্কায় গোটা দেশে সতর্কতা জারি করল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সরকারের সবথেকে বড় উদ্বেগের কারণ হল ইলাহাবাদের কুম্ভমেলা। জঙ্গিরা কুম্ভমেলায় হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, নরেন্দ্র মোদীর মতো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের কুম্ভে যাওয়ার কথা রয়েছে। যদিও মোদীর কুম্ভে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু তাতেও স্বস্তি আসছে কই? আফজলের মৃত্যুদণ্ডের খবর আসার পরেই সোপোর, বারামুলা-সহ উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় যে ভাবে কার্ফু উপেক্ষা করে জনতা পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তাতে কাশ্মীরে ফের বড় ধরনের অশান্তির আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দাদের। দিল্লির দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে ইতিমধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে উস্কানিমূলক বিবৃতি দিতে শুরু করেছে হাফিজ সইদ-সহ একাধিক জঙ্গি নেতা। রাতে কাশ্মীরের মেন্ধর সেক্টরে পাক সেনা সংঘর্ষ-বিরতি লঙ্ঘন করে গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সেনাবাহিনী।
শনিবার সকালে তিহাড় জেলে আফজল গুরুকে ফাঁসি ও কবর দেওয়ার বেশ কিছু ক্ষণ আগে থেকেই বাড়তি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয় রাজধানীর সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাস এবং বাজারগুলিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টেও ফের হামলার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণের উদ্দেশ্যই ছিল আফজল গুরুর ফাঁসি পিছিয়ে দিতে সরকার ও বিচারবিভাগের উপর চাপ বাড়ানো। আজ আফজলের ফাঁসিকে ‘বিচারবিভাগীয় সন্ত্রাস’ বলে আখ্যা দিয়েছে লস্কর-প্রধান হাফিজ সইদ। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট, দিল্লি হাইকোর্ট-সহ একাধিক আদালত চত্বরে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে।
সরকারের অবশ্য অনেক বেশি মাথাব্যথা কাশ্মীর নিয়ে। দু’একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা বাদ দিলে গত কয়েক মাস ধরে কাশ্মীর যথেষ্ট শান্ত। দীর্ঘদিন পরে গত বছর রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকও গিয়েছিলেন। উপত্যকা অশান্ত হয়ে উঠবে, মূলত এই আশঙ্কা থেকেই আফজল গুরুর ফাঁসির সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিল কেন্দ্র। কিন্তু আজকের পরে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির প্রত্যক্ষ প্ররোচনা এবং এ পারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির মদতে কাশ্মীরে নতুন করে গণ্ডগোল শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। শুক্রবার রাতেই তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে টেলিফোনে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে আফজলের ফাঁসির খবর আগাম জানিয়ে দেন বলেই সরকারি সূত্রের দাবি। এর পরেই শনিবার সকাল থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় কার্ফু জারি করা হয়। বিশেষ করে আফজলের গ্রামের বাড়ি সোপোর এবং বারামুল্লা জেলায় গণ্ডগোলের আশঙ্কা সবথেকে বেশি বলে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট। গুজব এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া রুখতে বিশেষ কিছু এলাকায় মোবাইল, ইন্টারনেট ও কেব্ল টিভি পরিষেবাও বন্ধ রাখা হয়।
কাশ্মীরের দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাই এখন দিল্লিতে। সৈয়দ আলি শাহ গিলানি চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে রয়েছেন। আর এক নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুক মিশরে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য ভিসার ব্যবস্থা করতে দিল্লিতে এসেছিলেন। দু’জনকেই গৃহবন্দি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “মূলত উস্কানিমূলক বিবৃতি থেকে বিরত রাখতেই এই দু’জনকে আটক রাখার সিদ্ধান্ত। শ্রীনগরেও হুরিয়তের নেতা ও মুখপাত্রদের আটক করা হয়েছে। সবটাই সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা।” কিন্তু এত কিছু পরেও শনিবার উপত্যকার কিছু মানুষ যে ভাবে কার্ফু ভেঙে পথে নেমেছেন, তাতে উদ্বেগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
ফারুকের সংগঠন ইতিমধ্যেই কাশ্মীরে চার দিনের শোকপালনের ডাক দিয়েছে। কাশ্মীরে জনতার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, এই অভিযোগে প্রচারে নেমেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি। পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী সংগঠনগুলি যে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে, তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। আফজলকে ‘শহিদ’ এবং ‘নির্দোষ’ আখ্যা দিয়ে জঙ্গি নেতা কাশ্মীরিদের পাশে থাকার কথা বলেন। হাফিজ সইদের প্রকাশ্য সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়া করাচি, লাহোর ও ইসলামাবাদে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, একেবারে পরিকল্পিত ভাবেই কাশ্মীরে অশান্তি তৈরির চেষ্টা চলছে।
সরকারের আরও এক উদ্বেগের জায়গা কুম্ভমেলা। বস্তুত এই মুহূর্তে কুম্ভমেলা নিয়েই বেশি উদ্বেগে গোয়েন্দারা। কারণ মেলায় কোটি মানুষের ভিড়ের মধ্যে নাশকতা ঘটানো জঙ্গিদের পক্ষে কতটা সহজ, তা ভালই জানেন তাঁরা। কুম্ভের ভিড়ের মধ্যে অতি সাধারণ কোনও বিস্ফোরণও বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আগামী কাল, রবিবার মৌনী অমাবস্যার শাহী স্নান। এই উপলক্ষে ইতিমধ্যেই বহু লক্ষ মানুষ ভিড় করেছেন ইলাহাবাদে। আরও কয়েক লক্ষ লোক শনিবার রাতেই ঢুকে পড়বেন। সব মিলিয়ে এক বিপুল সংখ্যক লোকের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গেই যোগ হয়েছে ভিআইপিদের সফরের প্রস্তুতি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষস্তর থেকে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা
মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অতীতেও বারাণসীতে গঙ্গার ঘাটে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা।
কেন্দ্রের আশঙ্কা, লস্কর-ই-তইবা তো বটেই, হিজবুল মুজাহিদিন, হরকল-উল-জেহাদি-ইসলামি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মতো পাক-মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলি যেমন নাশকতা চালাতে পারে, তেমনই পাক-সীমান্তও ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তাই জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থান ও পঞ্জাবের সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ ও সেনাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সীমান্তের ও পার থেকে আসা কোনও প্ররোচনাতেই যাতে জওয়ানেরা পা না দেন, সে জন্য কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে জঙ্গি অনুপ্রবেশের চেষ্টা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না বলে জানিয়েছেন বিএসএফ-কর্তারা।
|
|
|
|
|
|