বিজেপির পুরনো হাতিয়ার কেড়ে নিতেই কঠোর অবস্থান
প্রথম ইউপিএ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, কাশ্মীরে বড় ধরনের বিস্ফোরণ এবং সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল তখনই। প্রণব মুখোপাধ্যায় সে সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, “বিজেপি গুজরাতে দাঙ্গা করে জাতীয়তাবাদী সাজতে চাইছে। কিন্তু আমরা জাতীয়তাবাদটা ইন্দিরা গাঁধীর থেকে শিখেছি। যিনি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছিলেন। ইউপিএ জমানায় কংগ্রেস দেখাবে, সাম্প্রদায়িকতাটা জাতীয়তাবাদ নয়।”
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ইউপিএ-র দু’নম্বর সরকার দৃশ্যতই একটা কাজ করে দেখাতে মরিয়া। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিতে তারা যে পিছপা নয়, সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। তিন মাসের মধ্যে প্রথমে আজমল কসাব এবং এ বার আফজল গুরুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই বার্তাই পৌঁছে দিল কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র রশিদ আলভি পরিষ্কার বলে দিলেন, “স্বাধীনতার পরে এ দেশে সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় দু’টো ঘটনা ছিল সংসদ হামলা এবং মুম্বই হামলা। দু’টি ঘটনাতেই দোষীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল।” আর তার সঙ্গেই সাত বছরেরও বেশি পুরনো স্লোগানটা এক নিমেষে হাতছাড়া হয়ে গেল বিজেপির। ২০০৫ সালের ৪ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তার পর থেকে এক নাগাড়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলে এসেছে, ‘কেন আফজলকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে না সরকার?’ সাড়ে সাত বছরের টানাপোড়েন শেষ। বিজেপির এখন এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। ফলে রবিশঙ্কর প্রসাদ থেকে রাজীবপ্রতাপ রুডি, অরুণ জেটলি থেকে মুখতার আব্বাস নকভি সকলেই বলছেন, যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। আরও আগে হলে ভাল হত।
শিবসেনা সমর্থকদের উল্লাস। মুম্বইয়ে। ছবি: পিটিআই
কেন এই মুহূর্তটা বেছে নিল কংগ্রেস? কারণ, বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার এখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে নির্বাচনী কৌশল রচনা করছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদকে (বিজেপির ভাষায় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ) মূলধন করে বিজেপি এগোনোর ছক কষছে। সবেমাত্র রাজধানীর শ্রীরাম কলেজে এসে পড়ুয়াদের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়ে গিয়েছেন মোদী। এ বার কুম্ভমেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি (তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ রাতে জানা গিয়েছে, নিরাপত্তার কারণে মোদী না-ও যেতে পারেন)। গত সাত দিনে বিজেপি শিবিরে নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার থেকে বেশি আলোচনা হয়েছে কংগ্রেস শিবিরে। ঠিক এই সময়ে কসাবের পর আফজল গুরুর ফাঁসির সিদ্ধান্ত নিয়ে সনিয়া গাঁধী বিজেপিকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিলেন। খোদ মোদীকেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করে বলতে হল, “দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে।”
পাশাপাশি ‘হিন্দু সন্ত্রাস’ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্দের বক্তব্যের মোকাবিলায় আসন্ন বাজেট অধিবেশনে শিন্দেকে বয়কট করার পরিকল্পনাও ছিল বিজেপির। ঠিক সেই সময়, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এ হেন কঠোর অবস্থান সরকারের ভাবমূর্তিকে অনেকটা এগিয়ে দিল, সন্দেহ নেই। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে শিন্দেরই মন্ত্রক। শিন্দে আজ বলেছেন, “প্রাণভিক্ষার সব ক’টি আর্জিই রাষ্ট্রপতি নতুন করে খতিয়ে দেখার জন্য ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আমি ফাইলগুলো দেখে মন দিয়ে দেখে ২১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করি, আফজলের মৃত্যুদণ্ড যেন মকুব করা না হয়।”
গত কয়েক দিন ধরেই তৎপরতা চলছিল কংগ্রেস শিবিরে। জয়রাম রমেশের চেন্নাই সফরে যাওয়ার কথা ছিল এই সপ্তাহের শেষে। রাহুল গাঁধীর নির্দেশে সে সব বাতিল করে জয়রাম ও তাঁর সতীর্থরা বৈঠকে বসেন পরবর্তী প্রচারের রণকৌশল ঠিক করতে। মূল্যবৃদ্ধি থেকে আর্থিক বৃদ্ধির পতন, সব কিছুকে কার্পেটের নীচে রেখে আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ডই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা সরকারকে একটা জবরদস্ত প্রশাসক হয়ে ওঠার সুযোগ দেবে বলে স্থির করা হয়। বিজেপির বরাবরের অভিযোগ, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত নরম অবস্থান নিয়ে থাকে কংগ্রেস। এই বিতর্কে আফজলের ফাঁসিতে বিলম্ব ছিল তাদের অন্যতম প্রধান তাস। আজ যখন মোদীও কেন্দ্রের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন, বিজেপির বাকি নেতারা ‘কেন দেরি’ তাই নিয়ে সওয়াল করে যাচ্ছেন। সরকারের পদক্ষেপের পিছনে নিজেদের কৃতিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করছেন। বলছেন, আফজলের ফাঁসি আইনি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি। জেটলি দাবি করছেন, জনমতের চাপই সরকারকে অবশেষে সেটা কার্যকর করতে বাধ্য করল। নচেৎ প্রক্রিয়াটা কেন এত দিন ধরে ঝুলে ছিল? “উত্তরটা খুঁজে বার করতে হবে”, বলছেন রবিশঙ্কর।
এইখানেই বিজেপি-কে পাল্টা আক্রমণে যাচ্ছে কংগ্রেস। দিগ্বিজয় সিংহ কন্দহর-কাণ্ডের স্মৃতি উস্কে দিয়ে বলছেন, “জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতা বিজেপি করেনি বুঝি? কন্দহর কাণ্ডের সময় কে ছেড়ে দিয়েছিল জঙ্গিদের?” রাজনীতির কারবারিদের অনেকেরই মনে আছে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরের কথা। কন্দহরে বিমান অপহরণের ঘটনায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় তুলকালাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দিকে। প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন এনএসজি কেন অমৃতসর বিমানবন্দরে অপহরণ রুখতে ব্যর্থ হল। তৎকালীন এনএসজি-প্রধান নিখিল কুমার তখন পুরো অভিযানের সিডি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে জমা দিয়ে বলে গিয়েছিলেন, এটা তাঁদের দোষ নয়। সন্ত্রাস দমনে কেন্দ্রের কোনও নির্দিষ্ট নীতি নেই। ফলে সাধারণ যাত্রী নিহত হতে পারেন, এই ভয়ে নর্থ ব্লকই এনএসজি-কে গুলি চালাতে নিষেধ করেছিল।
তোপের মুখে ক্ষুব্ধ নিখিল সেদিন আডবাণীর সঙ্গে দেখাও করেননি। স্বরাষ্ট্রসচিব কমল পাণ্ডের সঙ্গে দেখা করে চলে আসেন তিনি। অপহৃত বিমান মুক্ত করতে কী করা হবে? বৈঠকে বসে ক্যাবিনেট। স্থির হয়, যাত্রীদের বাঁচানোর তাগিদে বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ পাক জঙ্গি মৌলানা মাসুদ আজহারকে ছেড়ে দিয়ে আসবেন। তখনও প্রবল আপত্তি তোলেন আডবাণী। মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিসেন। শেষমেশ বাজপেয়ী তাঁকে নিরস্ত করেন।
সংসদ হামলাও এনডিএ জমানারই ঘটনা। সেই হামলার চক্রী আফজলকে ফাঁসি দিয়ে এ বার বিজেপির হাওয়া কাড়ল কংগ্রেস। উজ্জীবিত যুব নেতা মনিন্দর সিংহ বিট্টা বলছেন, এ বার রাজীব গাঁধীর ঘাতকদের ঝোলানোর দাবিতে পথে নামবেন তাঁরা। কংগ্রেসও ফাঁসির প্রশ্নে ‘বারবার তিন বার’-এর রাস্তায় হাঁটে কি না, সেটাই এখন দেখার।

সে দিন সংসদে
১১-৪০ সংসদ চত্বরে ঢুকল লালবাতি লাগানো সাদা অ্যাম্বাসাডর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্টিকার থাকায় বিনা পরীক্ষায় প্রবেশ।
১১-৪০ উপরাষ্ট্রপতি কৃষ্ণকান্তের জন্য অপেক্ষারত কনভয়ে ধাক্কা মারল ওই গাড়িটি। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বচসা শুরু।
১১-৪৫ অ্যাসল্ট রাইফেল বের করল গাড়ির আরোহী জঙ্গিরা। গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন চার নিরাপত্তারক্ষী। লড়াই শুরু।
১১-৫৫ লাগাতার গুলি বিনিময়ে হতাহত আরও নিরাপত্তারক্ষী। বন্ধ করে দেওয়া হল সংসদের সব দরজা। সাংসদরা থরহরি কম্প।
১২-০০ মূল ফটকে মানববোমার বিস্ফোরণ। সংসদ ভবনে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ জঙ্গিরা। সাংসদদের জড়ো করা হল সেন্ট্রাল হলে।
১২-১৫ সংসদ চত্বরে ঢুকতে শুরু করলেন শ’য়ে শ’য়ে জওয়ান। কমে এল গুলির শব্দ। নিরাপত্তাবাহিনী জানাল, পাঁচ জঙ্গি খতম।
১২-৪৫ অবস্থা শান্ত। তবে এক জন জঙ্গি ভিতরে লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা। পরে অবশ্য নিরাপত্তাবাহিনী জানাল, আশঙ্কা অমূলক।
৪-০০ ভিতরে পড়ে থাকা বিস্ফোরক ফাটিয়ে দিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বিস্ফোরণের শব্দেই শেষ হল একটি বিস্ফোরক অধ্যায়।
প্রসঙ্গ ফাঁসি
দেশের আইনকে সেলাম জানাই। ভারত যা করেছে, আইনের মধ্যে থেকেই করেছে।
খুব ভাল সিদ্ধান্ত। তবে আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। বিশ্বকে বার্তা দেওয়া দরকার যে, ভারত সন্ত্রাস সহ্য করে না।
খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগার দিওয়ান ফাঁসিটা তো অনুচিতই, মানবিকতার খাতিরে সরকারের উচিত ছিল অন্তত আফজলের দেহ সংসদ হামলাটা খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। নিহত নিরাপত্তা কর্মীরা সুবিচার পেলেন।
জঙ্গিদের সঙ্গে বিজেপি সমঝোতা করেনি? কন্দহর কাণ্ডের সময় জঙ্গিদের কে ছেড়ে দিয়েছিল?
দের আয়ে, দুরস্ৎ আয়ে।
জনমতই সরকারকে নড়ে বসে আইনের পথে হাঁটতে বাধ্য করল।
যখন এত সন্দেহ রয়েছে, যখন কাউকে শুধু পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তখন এত তাড়াহুড়ো করে ফাঁসি কেন? স্রেফ ভোটের মুখে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে এটা করা হল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.