প্রবন্ধ ২...
‘এই হল গিয়ে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ বললে কি চলে?
যুক্তি দিয়েই তো তক্কো জুড়ি আমরা। কিন্তু সেই তক্কো যদি নেই-মামাকে নিয়ে হয় তা হলে গপ্পো জমানো মুশকিল, একটা কানা মামাকে অন্তত জোগাড় করতে হয়। ঠিক তেমনই, শুধু ‘এটা করব না, ওটাও করব না’ বলে স্লোগান তৈরি করলে হইচইয়ের মঞ্চ তৈরি হয় বটে, কাজের জমি তৈরি হয় না। স্লোগান একটা বিশেষ অবস্থানের কথা বলতে পারে। কিন্তু স্লোগানে অবস্থানের বৃত্ত শুরু হতে পারে, সে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় প্রশাসনিক নীতিতে পৌঁছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজচক্কোত্তিরা স্লোগান দিচ্ছেন দারুণ, সেই স্লোগানের মানমর্যাদা রেখে একটা কাজের, বা নিদেনপক্ষে কাজ-চালানোর মতো প্রশাসনিক নীতি এবং কার্যক্রম তৈরি করতে পারছেন না, তার চেষ্টাও করছেন না। মানে নেই-মামা থেকে কানা-মামায় পৌঁছতে পারছেন না।
ধরা যাক জমি। দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান হল: সরকার প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে কোনও জমি নেবে না। দলের এই অবস্থান সিঙ্গুর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পাকা রাজনৈতিক আসন তৈরি করে নিয়েছে। দলের দাবি, এই ভাবে জমি অধিগ্রহণ করলে অনেক সময়েই যাঁরা অনিচ্ছুক তাঁদের ইচ্ছাও সমষ্টির ইচ্ছার কাছে বলি হয়ে যায়।
জমি আছে, সরকারও আছে, নীতি নেই।
এটা ছিল দলীয় একটা অবস্থান। ভোটে জেতার পরে এই দলীয় অবস্থানকেই এখন রাজ্যের নীতি হিসাবে তুলে ধরেছে সরকার। অবস্থানটা ঠিক না ভুল, এক কথায় তার কোনও উত্তর হয় না। এটা শেষ বিচারে মতামতের প্রশ্ন। হয়তো বিশ্বাসেরও। কিন্তু এই অবস্থানের অনুসারী এক সুচিন্তিত সার্বিক প্রয়োগপত্র তৈরি করতে পারলে তবেই সেটা যথার্থ জমি নীতি হয়ে উঠতে পারে। আর সে কাজটা ঠিক ভাবে করা গেলে শাসক দলের স্লোগান রাজ্যকে শিল্পায়ন-বিরোধী না করে বিনিয়োগবন্ধু করে তুলতে পারত। কী ভাবে? এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রশাসন কী বলছে? যে বিনিয়োগ করতে চাইবে সে তার পছন্দ মতো জমি কিনে নিক জমির মালিকদের কাছ থেকে। এর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু শিল্পমহলের প্রশ্ন: এক লপ্তে বড় জমি কেনার নানান সমস্যা থাকে। জমি এক এক করে কিনতে হয়। এ বার, প্রতিটি জমি কেনার পরে অন্য জমির মালিক চাহিদা বুঝে বেশি দাম হাঁকে। এক দিকে খরচ বেড়ে চলে, অন্য দিকে প্রথম মালিকের মুখ হাঁড়ি হয়। তৈরি হয় একটা দ্বন্দ্বের জায়গা। এখানে প্রশাসনের কী ভূমিকা হবে? নীতি রচনার জন্য এই প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য এবং কার্যকর উত্তর জরুরি।
অথচ তেমন কোনও সদুত্তর রাজ্য সরকার এখনও দিয়ে উঠতে পারেনি। পারেনি, কারণ সরকার তার অবস্থানের প্রয়োগপত্র তৈরি করে উঠতে পারেনি। তৈরি করে উঠতে পারেনি কোনও সাধারণ সূত্র। ফলে যেটুকু লগ্নি হচ্ছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে সেই লগ্নিটির জন্যই। ওই সিদ্ধান্ত যে একই ধরনের অন্য লগ্নির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হবে, সার্বিক প্রয়োগপত্রের অভাবেই তার কোনও প্রশাসনিক গ্যারান্টি থাকছে না। ফলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। পকেটের টাকা ফেলে জমি কিনে তার পর কারখানা করতে না-পারার ক্ষতি কেউ স্বীকার করতে চাইবে না। জমি নীতির প্রেক্ষিতে এই ঝুঁকিটাই লগ্নির পথে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তা হলে উপায়? শাসক দল যদি তাঁদের অবস্থান বজায় রাখেন, তবে সেখানে দাঁড়িয়েই তাঁদের উপায় খুঁজতে হবে। সাধারণ ভাবে, এই অবস্থানের পক্ষে দু’টি যুক্তি দেওয়া হয়। এক, উচ্ছেদের সমস্যা। এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গ্রাসাচ্ছাদনের সমস্যা। জমি বিক্রি হয়ে গেলে সাধারণ মানুষ সে টাকা থেকে নতুন আয়ের রাস্তা বার করতে পারে না। টাকা ফুরিয়ে যায়।
দ্বিতীয় যুক্তিটা আর একটু জটিল। সেটা একটা প্রতিযুক্তি। জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পায়নের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা বলেন, একটা শিল্প হলে তার হাত ধরে আসে অন্য চারটে। তৈরি হয় নতুন কর্মক্ষেত্র। যাঁরা জমি বা জীবিকা হারাচ্ছেন, তাঁরা সেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে পারেন। এরই প্রতিযুক্তি হিসেবে বলা হয়: যাঁরা জমি হারান, এই নতুন কর্মক্ষেত্রে তাঁদের জন্য কাজ তৈরি হয় না। তৈরি হয় অন্য মানুষের কাজের সুযোগ। এখানেই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে যুক্তিটা জোরদার হয়।
সমস্যাটার চরিত্র যদি এই হয়, তা হলে সেই চরিত্র ধরেই তো একটা সমাধান খুঁজতে হবে। এ রকম নয় যে সমস্যাটা রাজ্যের একার। বিশ্ব জুড়েই শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যা হয়েছে বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু কোথাওই সরকার এই ভাবে শিল্পের জন্য জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে ফেলেনি। ফেলেনি, কারণ জমিদাতাদের স্বার্থরক্ষার জন্যই শিল্পের জন্য জমি কেনার ব্যাপারে সরকারের জড়িত থাকা দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাজারনির্ভর রাষ্ট্রের রাজ্যগুলিরও জমি অধিগ্রহণের জন্য রয়েছে ‘ডোমেন পাওয়ার’।
তার মানে এই নয় যে, সরকারকে সরাসরি জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে। সরকার না হয় না নিল জমি। কিন্তু সরকার তো সেই ব্যবস্থা করতেই পারে যাতে কৃষকরা একজোট হয়ে এমন ভাবে শিল্পের জন্য জমি দিলেন যাতে তাঁদের আয়ের উৎস অব্যাহত থাকল, উল্টে আর্থিক অবস্থান আরও দৃঢ় হল! একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। পুণের কাছে মগরপাট্টার উদাহরণ। মগর একটি সম্প্রদায়ের নাম। আয় কৃষি থেকেই। তাঁদেরই একজন সতীশ মগর। সম্প্রদায়ের ১২০ জনকে এককাট্টা করে ৪০০ একর জমিতে তিনি তৈরি করেছেন শিল্পনগরী। নাম মগরপাট্টা। লিজের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন নিয়মিত। ফলে সম্পত্তি বিক্রি বাবদ পাওয়া টাকা কী ভাবে রাখব, সেই চিন্তা নেই। একই সঙ্গে এঁরা ব্যস্ত নানান ছোট ব্যবসা নিয়ে। যে সব সংস্থা এসেছে তাদের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আরও রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে। মাথাপিছু রোজগার বেড়েছে গোটা অঞ্চলেরই। মগরপাট্টা আজ অনেকের কাছে একটা মডেল। এমন নানান মডেল ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে মডেলই নেওয়া হোক, সরকারের সহায়ক ভূমিকা জরুরি। সেই প্রশ্নেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিরুত্তর।
শিল্প যখন বলে, ‘শিল্পনীতি দেখাও’, তারা চায় সরকারের প্রয়োগ নীতির খোঁজ। “আমি এখানে টাকা ঢালব, তুমি তার জন্য কী করবে বল?” এটাই তাদের প্রশ্ন। হলদিয়ার ‘বেঙ্গল লিডস’ যদি কোনও ইঙ্গিত হয়, তা হলে ব্যর্থতা কিন্তু শিল্পপতি টানায় নয়। ব্যর্থতা একই স্লোগানের পুনরুল্লেখে। ব্যর্থতা প্রয়োগপত্র তৈরি করায়। সরকারি স্লোগান, অবস্থান, নীতি, আদর্শ, এ সবই ঠিক আছে, যদি তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার শিল্পের উপযোগী একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রয়োগনীতি তৈরি করতে পারে। এখানে কিছুটা ওখানে কিছুটা জমি নিয়ে ‘এই দেখ আমাদের ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ বললে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয় না।
‘নেই মামা’ দিয়ে গপ্পো হয় না, তা বোঝার সময় এসেছে। অন্তত একটা কানা মামা তৈরি করে তো দেখান।
আরও গভীর প্রশ্ন হল: যেখানে অবস্থানটাই আসলে দায় ঝেড়ে ফেলার, সে ক্ষেত্রে প্রয়োগপত্র তৈরিই বা হবে কী ভাবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.