প্রবন্ধ ১...
জয়পুর ও আশিস নন্দী বিশেষজ্ঞতা ও গণতন্ত্র
য়পুরে সাহিত্য উৎসবে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর একটি কথা নিয়ে কোর্টকাছারি হচ্ছে, সরকার-পুলিশ তো হয়েইছে, মুখ্যমন্ত্রী-কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছেন, আশিসের গ্রেফতার একটি রাজনৈতিক দাবি হয়ে উঠেছে।
এ-নিয়ে কোনও তথ্য-সংগ্রহ না করেও বুকে বল নিয়ে বলা যায়, এই সব হাঙ্গামায় যাঁরা স্বনাম রক্ষায় গলা মিলিয়েছেন সেই মন্ত্রী ও নেতারা ও যাঁদের এজলাশে মামলা উঠতে পারে, সেই হাকিমদের অনেকেই আশিস নন্দীর নাম এই প্রথম শুনলেন। আশিস নন্দী সমাজবিজ্ঞানকে একটি বিশেষ আয়তন দিয়েছেন সমাজবিদ্যার সঙ্গে মনস্তত্ত্ব যোগ করে। সমাজবিজ্ঞানেরও এ এক বিশিষ্ট বিভাগ। এ বিশিষ্ট বিভাগে চিন্তাভাবনা করার মানুষ পৃথিবীতেই কম, ভারতে আরও কম। সারা দুনিয়াতে এই বিষয়টিকে ফরাসি দার্শনিক লাকাঁর চিন্তাভাবনা নতুন আয়তন দিয়েছে।
আমার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন যে, আশিস নন্দী সমাজমনের যে-পার্শ্বদেশ নিয়ে কাজ করেন, সেই পার্শ্বদেশ এমনকী সমাজবিজ্ঞানীদেরও খুব চেনা মুখ।
তা হলে এত জঙ্গি আন্দোলন কী নিয়ে এবং কেন?
আশিস কী বলেছেন ও তাঁর কথায় কী শোনা হয়েছে সে-বিষয়ে কিছু বলার আগে আমার দুটো প্রশ্ন: আশিস নন্দী এই সম্মিলনে গেলেন কেন ও এই জয়পুর উৎসবের সংগঠকরা আশিস নন্দীকে ডাকলেন কেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর অনুমান করাও কঠিন। এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কোনও বন্ধুর অনুরোধে আশিস নন্দী গিয়েছেন। একটা মেলা মতো হচ্ছে, লোকজনের সঙ্গে দেখাশোনা ও কথাবার্তা হবে না যাওয়ারই বা কী আছে। আশিস নন্দী মানুষ হিসেবেও একটু ভোলেভালা তাঁকে নিয়ে যাওয়াও এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। যেমন, তাঁর পক্ষে এমন গোপন উচ্চম্মন্যতা লালনও সম্ভব নয় যে, তাঁর তাত্ত্বিক গবেষণা এই ধরনের ফেস্টিভাল-মঞ্চে উত্থাপনীয় নয়।
শিল্পী: সুমিত্র বসাক
সেটা তো বেশি বোঝা উচিত ছিল এই ফেস্টিভালের সংগঠকদের। তাঁরা ভেবেছেন কী ভাবেননি সেটা প্রাসঙ্গিক কথা নয়। এই সংগঠকরা এই ধরনের ফেস্টিভালের বিনিয়োগকারী। জয়পুর ফেস্টিভালের সময়ে একটা হিসেব বেরিয়েছিল যে ফেস্টিভালের প্রধান ব্যবস্থাপক বলেছেন লসের পরিমাণ এত বেশি বা লাভের পরিমাণ এত কম (১০ কোটির এ-দিক ও-দিক) যে, আগামী বছর ফেস্টিভাল জয়পুরে না-ও হতে পারে।
আমি কোনও নৈতিক প্রশ্নের ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছি না। কেউ যদি মনে করেন এখন ফেস্টিভাল বিনিয়োগযোগ্য একটি ব্যাবসা যেখানে খাটানো-টাকা হাতে-হাতে উঠে আসে, তা হলে তিনি সেখানে টাকা খাটাতেই পারেন। প্রধানত দিল্লিতে একটা নতুন বিনিয়োগক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বিয়েবাড়ির কন্ট্রাক্ট। আপনি থিমেটিক বিয়েবাড়ি চান না পারিবারিক বিয়েবাড়ি চান, সেই চাহিদা মতো কোটি-কোটি টাকা খাটিয়ে সে বিয়েবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে।
এমনকী সিনেমায় দেখা বিয়েবাড়িরও কন্ট্রাক্ট নেওয়া হচ্ছে। দিল্লি কর্পোরেশন প্রস্তাব করেছে প্যান্ডেল অনুযায়ী বিয়েবাড়ির ট্যাক্স বসানো হবে। এই লিটারারি ফেস্টিভালগুলোও তেমনই একটি বিনিয়োগক্ষেত্র। কয়েক জন খ্যাতিমান মানুষকে দেখিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের বিশিষ্ট বিনোদন। এই ধরনের বিনিয়োগে আশিস নন্দীর গোলমাল ফেস্টিভালের আকর্ষণ বাড়ায়। গত বছরও রুশদি-নয়পল এ-সব নিয়ে ভাল ঘোঁট হয়েছিল। এ বারের ঘোঁটটা নিম্নবর্গ, মন্ত্রীটন্ত্রি, কোর্টকাছারি মিলে একটু বেশি গোলমেলে হয়ে উঠেছে।
তার কারণ, গণতন্ত্র ও বিশেষজ্ঞতা বিনিয়োগের মঞ্চে একত্রিত হয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থ অধিকারের কোনও জাত ভেদ নেই। তার বিপজ্জনক অর্থ তো এটা হতে পারে না যে, বিশেষজ্ঞতার কোনও অধিকারভেদ নেই। যে-কেউ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন এই পর্যন্ত গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্র তো যে-কাউকে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারে না। হওয়া আর বানানো দুটো আলাদা কাজ। আশিস নন্দীর বক্তব্য নিয়ে যে-কাণ্ড হচ্ছে, তাতে এই ভয়টাই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে মন্ত্রীরা বা হাকিমরাই এখন যে-কাউকে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারেন।
কী বলেছেন আশিস নন্দী? পুরো পেপারটা আমি পাইনি। যা পেয়েছি তাতেই বুঝেছি। না-পেলেও বুঝতাম। ওঁর সারা জীবনের কাজের সঙ্গে পরিচয় থেকেই জানি উনি কী বলতে পারেন। ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামে একটি উপন্যাস লেখার সময় সংরক্ষণের সূত্রপাত যে দ্বিতীয় গোলটেবিলে, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাঁদে (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড) ও ১৯৩৫-এর ‘ভারত শাসন আইন’-এ তার তত্ত্বতালাশ আমাকে খুঁজতে হয়েছিল এমনকী দেশান্তরের মহালেখ্যাগারেও। সেখানে এমন তথ্যও এক জন মুসলমান পুলিশ অফিসারের জবানিতে দেখেছিলাম সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গোপন খবর যাঁরা পুলিশের কাছে পয়সার বিনিময়ে দিয়ে যেতেন, তাঁরাও বেছে নিতেন হিন্দু অফিসার, যাতে রিওয়ার্ডের টাকা এক জন হিন্দু পান। সাম্প্রদায়িকতা ডি-এন-এর চাইতেও অনপনেয় উপাদান ঘুষ ও রিওয়ার্ডের টাকাতেও জাতিভেদ সক্রিয় রাখে।
আশিস নন্দী এক জটিল কৌম মানসিকতার উপাদান বিশ্লেষণ করেছেন। সংরক্ষণ এমন আইন নয়, যা বিধিবদ্ধ হলেও কার্যকর হয়। সেই বাধাবিঘ্ন উতরে সংরক্ষিত গোষ্ঠীর অন্তর্গত হয়েও কেউ কেউ সরকারের উচ্চপদে যেতে পারতেন। বা, এখন, কোনও কোনও রাজ্যের সরকার পর্যন্তও তৈরি করতে পারছেন। তাঁরা, উঁচুজাতের নেতামন্ত্রীদের সমতুল্য মর্যাদা পেতে ঘুষ-খাওয়াটাকে একটি গ্রহণযোগ্য সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিতেন ও নিচ্ছেন।
ভারতের অজস্র জটপাকানো হিন্দু ও হিন্দু-প্রান্তিক সমাজের লুকনো তাকবন্দি ব্যবস্থার গতিমুখের সংকেত তৈরি করেছেন আশিস নন্দী। সেই তাকবন্দি ব্যবস্থা এখন একটা রূপান্তরে পৌঁছেছে। এর রূপান্তরণ ক্ষমতা অচিন্তনীয়।
এখন একটা ধারণা তৈরি হয়ে আছে যে, হিন্দুসমাজের সেই তাকথাক ভেঙে গিয়েছে। বস্তুত সেই তাকথাক পোস্টমডার্ন হয়েছে। এই সংকেতের বর্ণপরিচয় যাঁদের নেই, তাঁরাও তাঁর গ্রেফতার দাবি করছেন ও আদালত তাঁদের কথাও সমমর্যাদায় শুনছে এটা গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রেরই একটা নিষেধও তো থাকা উচিত। যার কাজ, কাজটা তাকেই করতে দেওয়া হোক।
আশিসকে তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরেই ও আমার তত্ত্বতালাশ থেকেই আরও একটা অন্বেষণসূত্র দিতে চাই। ১৯৩৫-এর আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে যে সব রাজ্যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা হল, প্রায় বেশির ভাগ প্রদেশেই বেছে-বেছে তফসিলিদেরই কেন আবগারি মন্ত্রক দেওয়া হত? আর সেই অভ্যেসটা স্বাধীন হওয়ার পরও অপরিবর্তিত থাকলই বা কেন?
গ্রেফতারই যদি হতে হয়, আশিস, তবে সব কথা বলে হওয়াই ভাল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.