আত্মপ্রকাশের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাশ্মীরে মেয়েদের গানের ব্যান্ড নিষিদ্ধ হইয়া গেল। শ্রীনগর উপত্যকার দশম শ্রেণির তিন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী নোমা নাজির, ফারা ডিবা এবং অনিকা খালিদ কণ্ঠসঙ্গীত, গিটার ও ড্রাম বাদনের তালিম লইয়া ‘প্রাগাশ’ নামে একটি ব্যান্ড তৈয়ার করিয়াছিলেন। শ্রীনগরে সম্প্রতি অনুষ্ঠেয় ব্যান্ড-প্রতিযোগিতায় তাঁহাদের চমকপ্রদ গান-বাজনার উৎকর্ষ পুরস্কৃতও হয়। কিন্তু তাহার পরেই ধর্মগুরু এবং সমাজপতি জ্যাঠামহাশয়রা নড়িয়া বসেন। একে ইসলামে গানবাজনা নিষিদ্ধ, তায় আবার মেয়েদের প্রকাশ্য স্টেজে উঠিয়া গান করা? অতএব কাশ্মীরের গ্র্যান্ড মুফতির ফতোয়া: মেয়েদের ব্যান্ড নিষিদ্ধ হউক। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংগঠন হুরিয়তের গিলানিপন্থী মোড়লরাও হুঙ্কার ছাড়েন। হুমকি দেওয়া হয় সামাজিক বয়কটের। মেয়েদের অভিভাবকদের কাছেও পৌঁছাইয়া দেওয়া হয় সেই হুঁশিয়ারি। বাধ্য হইয়া ব্যান্ড-সদস্যা মেয়েরাই তাঁহাদের সাধের ব্যান্ড বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেন।
জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা ব্যান্ডের মেয়েদের সমর্থনে দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু কাশ্মীরের মতো মৌলবাদ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে তাঁহার সরকারের ক্ষমতা নাই উহাদের নিরাপত্তা দিবার। জঙ্গিরা সেখানে ইতিপূর্বে অনেক লঘুতর ‘অপরাধে’ (কলেজছাত্রীর পায়ের ডিম দেখা যাইতেছিল বলিয়া) মেয়েদের গুলি করিয়াছে, মুখে অ্যাসিড ছুড়িয়া মারার হুমকি দিয়াছে, মারিয়াছেও। তাই স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা বা তাহাদের অভিভাবকরা মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে কিংবা তাঁহার পুলিশের হম্বিতম্বিতে ভরসা রাখিতে পারেন নাই। মুষ্টিমেয় কিছু মৌলবাদীই চিরকাল বৃহৎ সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া আসিয়াছে, তাহাদের ধারণা ও সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার সাহস বা স্পর্ধা জনসমাজের বিবেকবান মানুষদের হয় নাই। ইসলামেরই সুফি ঐতিহ্যে পশ্চিম এশিয়ায় মরমিয়া ভক্তি-সঙ্গীতের যে বিকাশবৃদ্ধি, উপমহাদেশে কাওয়ালির যে স্ফূর্তি, হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীতে খান-ওস্তাদদের যে উদ্যাপন, মৌলবি-মুফ্তিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়াই তাহা সমৃদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু বৃহত্তর মুসলিম সমাজকে সন্তর্পণে সে সবের স্পর্শ হইতে দূরে সরাইয়া রাখিতে সদাসচেষ্ট মৌলবাদীরা।
কলিকাতায় তাহাদেরই জ্ঞাতিভ্রাতারা তসলিমা নাসরিনকে বিতাড়িত করিয়াছিলেন, সম্প্রতি সলমন রুশদিকেও ‘নিষিদ্ধ’ করিয়াছেন। তামিলনাড়ুতে তাঁহারাই কমল হাসানের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারিতে চাপ দেন। মণিরত্নমের চলচ্চিত্রও নিষিদ্ধ করিতে খ্রিস্টান মৌলবাদীরা তৎপর। সর্বত্রই রাজনৈতিক দল ও তাহার নেতৃত্ব (শাসক হউক বা বিরোধী) এই মৌলবাদীদের তোষণ করিয়া সেই তোষণনীতিকে ‘গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলিয়া চালাইতেছে। ইহার মধ্যে স্বাগত ব্যতিক্রম জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। তিনি অন্তত প্রকাশ্যে সমধর্মীদের ভোট হারাইবার পূর্ণ ঝুঁকি লইয়াও মেয়েদের ব্যান্ডকে সমর্থন দিয়াছেন এবং ব্যান্ডবিরোধীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চালাইবার হুমকি দিয়াছেন। ন্যক্কারজনক ভোটভাবনা তাঁহাকে জেহাদি মৌলবাদের কাছে নত হইতে শেখায় নাই। |