|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
গর্বিত হওয়ার সুযোগটা হারালাম |
কী হতে পারত, আর কী হল! একটা বিরাট গর্বের মুহূর্ত পেয়ে যেতে পারতাম আমরা, এই কলকাতাবাসীরা, খুব সহজে, প্রায় কিছুই না করে, কেবলমাত্র স্বাভাবিক থেকে। হল না। আমাদেরই ভুলে হারিয়ে ফেললাম সুযোগটা। স্বাভাবিকের বদলে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেললাম, গর্বিত হওয়ার বদলে লজ্জায় ছোট হয়ে গেলাম। সলমন রুশদি যে কলকাতায় আসার অনুমতি পেলেন না, তা নিয়ে ঠিক-ভুল অনেক তর্কবিতর্ক হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের রাজনীতিটা কেমন, সামাজিক তাৎপর্যটাই বা কী, অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। সে সব চলুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু একটা গোড়ার কথাও তার সঙ্গে বলা দরকার। এই মুহূর্তটা আমাদের কাছে একটা বিচ্ছিরি হারানোর মুহূর্ত। রুশদি যদি কলকাতায় সত্যিই আসতেন, সভায় গিয়ে কিংবা না-গিয়ে এই শহরের আলো-হাওয়ায় একটু সময় কাটিয়ে যেতেন, কিছু মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, কিছু মানুষের ক্ষোভবিক্ষোভ টের পেতেন, এবং শেষ পর্যন্ত নিরাপদে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে নিজের পরবর্তী গন্তব্যের উড়ানটি ধরে উড়ে যেতেন আমরা তেমন কিছুই না করেও কত বড়াই করতে পারতাম: এই আমাদের শহর, আমাদের তোমাদের ওদের সকলের, খোলা আর মেলা। ‘মেলা’ অর্থাৎ সবার মিলতে পারার জায়গা।
ঠান্ডা মাথায় যদি ভাবি এক বার, কী হত উনি এলে? চল্লিশ শতাংশ সম্ভাবনা, তেমন কিছুই হত না। ষাট শতাংশ সম্ভাবনা, নেতা-হোতা দ্বারা অনুপ্রাণিত বেশ কিছু লোক ভিড় জমিয়ে স্লোগান দিত, এমনকী হয়তো তাঁর উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টাও করত! তা, কলকাতার পুলিশ-প্রশাসন কি এতই ঠুনকো যে তারা কিছু গুন্ডাকে শায়েস্তা করতে পারত না? প্রয়োজনীয় কয়েকটি জায়গায় কড়া পাহারা লাগিয়ে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে পারত না?
ভাবতে গেলে আতঙ্কে শিহরন হয়। এই যদি প্রশাসনের হাল হয়, আর একটা ‘বাবরি মসজিদ’ ঘটলে কী হবে এই কলকাতার? বিমানবন্দরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেই সামাল দেওয়া যাবে তো?
লজ্জার ঘায়ে অপমানের ছিটে। এখন তর্কাতর্কি চলছে, রুশদিকে কেউ সত্যিই আসতে বলেছিলেন কি না। এঁরা বলছেন, ওই ওঁরা বলেছিলেন, ওঁরা বলছেন, কখ্খনও বলিনি, উনি নিজে হামলে পড়ে আসছিলেন। ছি ছি, কোথায় নামিয়েছি আমরা নিজেদের। কেউ রুশদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকলে তাতে তো তাঁদের গর্বিতই হওয়ার কথা ছিল, অত বড় মাপের ক’জন লেখককে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ পায় কলকাতা? শুধু ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-ই লিখেছেন রুশদি, ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ লেখেননি? আর, যদি কেউ তাঁকে আমন্ত্রণ না জানানো সত্ত্বেও তিনি এই শহরে আসার জন্য ব্যগ্র হয়ে থেকে থাকেন, তবে তো অহঙ্কারে আমাদের ছাতি তিন গুণ বাড়ার কথা ছিল! কত জন রুশদি এই বস্তাপচা কলকাতা শহরে নিজে থেকে আসার ইচ্ছে দেখান, আজকালকার দিনে?
ক্রমশই পিছন থেকে পিছনতর সারিতে তলিয়ে যাওয়া কলকাতা শহরের নাগরিক আমরা। আর কত ছোট করব আমাদের মন? আর কত সুযোগ হারিয়ে দরিদ্রতর হব?
অনুরাধা লাহিড়ি। কলকাতা-৯১
|
জ্যাঠামশাই! |
সংস্কৃতির পরিসরে কোনটা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল, সেটা নির্ধারণ করা যে কোনও সমাজগুরু জ্যাঠামশাইয়ের কাজ নয়, এমনটা বলে এসেছে আনন্দবাজার বছরের পর বছর। বিগত বছরগুলোয় এই বাংলা নানা সময়ে আলোড়িত হয়েছে শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিতর্কে। কখনও বই, কখনও সিনেমা, কখনও নাটককে খাড়া করানো হয়েছে কাঠগড়ায়। আনন্দবাজার সব সময়েই সওয়াল করে এসেছে যে, কোনও রকম সেন্সরশিপের বা শ্লীল-অশ্লীল ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে। আজও যখন আনন্দ প্লাস ক্রোড়পত্রে ‘নৈহাটি থেকে নাইট ক্লাব’ রচনায় (২১-১) জেন ওয়াইকে নিশি নিলয়ে গিয়ে ধুম মস্তি করার উপায় বাতলানো হয় ও সঙ্গে নাতিস্বচ্ছ পোশাক পরিহিতার ফুর্তিকালীন ক্লিভেজ-সুষমার ছবি ছাপা হয়, তখন এই সম্পাদকীয় নীতিই অনুসৃত হচ্ছে বলে আমরা ধরে নিই। তাই চমকে উঠতে হয়। এর পাশাপাশি আপনারা যখন ‘আইটিআইয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানেও অশ্লীল নাচ’ শীর্ষক খবর (২২-১) ছাপেন। একে স্ববিরোধিতা বা দ্বিচারিতা যে-কোনও নামেই ডাকা যায়, তাই নয় কি?
ভাস্কর রায়। কলকাতা-৭৭
|
আসতে না দিলে তর্কটা করব কী করে বলুন তো |
আমি সলমন রুশদির ভক্ত নই। তাঁর লেখা আমার ভাল লাগে না। শুধু তা-ই নয়, আমি মনে করি, তিনি এমন অনেক কথা লেখেন যা অন্যায়, অনেক চরিত্র তৈরি করেন মানুষকে বা কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে আঘাত করার জন্যেই। তাঁর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই সন্দেহটা আরও বেশিই হয়। মনে হয়, এই বিরাগটা আমার একার নয়, অনেকেই তাঁর লেখাকে এই কারণে অপছন্দ করেন।
কিন্তু সেই কারণেই আমার মনে হয়, সলমন রুশদিকে আমাদের বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তাঁকে এখানকার মানুষের মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে আমরা তাঁকে আমাদের আপত্তির কথা জানাতে পারি, তাঁর লেখা কেন আমাদের অন্যায় মনে হয়, সেটা যুক্তি দিয়ে বলতে পারি, তাঁর সঙ্গে তুমুল তর্ক করতে পারি। একটা সভ্য, গণতান্ত্রিক সমাজে ঠিক তেমনটাই তো হওয়ার কথা। এই খোলাখুলি তর্কটা করতে পারলেই তো তাঁর সমালোচক বা বিরোধীরা নিজেদের আপত্তির কথাটা ভাল করে জানাতে পারেন। |
|
অথচ বার বার কেবলই তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তাঁকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে আমাদের গণতান্ত্রিক আদর্শ তো লাঞ্ছিত হচ্ছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এক, তাঁর সঙ্গে বা তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে তর্ক করার সুযোগটাই আমরা হারাচ্ছি। দুই, তাঁকে নিয়ে তর্কটা কেবলই তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাদপ্রতিবাদের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে আজ অবধি সত্যিকারের সমালোচনা কতটুকু হয়েছে বলুন তো? ঠিক যেমন, তসলিমা নাসরিনকে কথায় কথায় ‘বিতর্কিত লেখিকা’ বলা হয়, অথচ তাঁর লেখা নিয়ে বিতর্ক কতটুকু হয়েছে? যাঁরা কথায় কথায় রুশদি বা তসলিমার মুণ্ডপাত করেন, তাঁরা প্রায় কখনওই সেই সব লেখা নিয়ে কোনও আলোচনা করেন না, তাঁদের মতামতের বিরুদ্ধে যুক্তি দেন না। হয়তো ভাল করে পড়েনই না।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে, অন্তত তার একটা বাতাবরণ আছে। সেটা একটা বিরাট সুবিধে। কোনও ব্যক্তি বা তাঁর মতামত বা সৃষ্টি সম্বন্ধে নিজের অপছন্দ বা আপত্তি জানানোর এই সুবিধেটা গণতন্ত্রই দেয়। আমরা সেটা হেলায় হারাচ্ছি। এটা কেবল অন্যায় নয়, খুব বড় বোকামিও বটে। কিন্তু মুশকিল হল, মহাকরণে যে-ই যায়, সে-ই এই আশ্চর্য বোকামির শিকার হয়। ওখানে কোনও ভূতপ্রেত আছে হয়তো।
জীবন বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা-২৬ |
|
|
|
|
|