এক দিকে ধস, ফাটল, ভূগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। অন্য দিকে বসতবাড়ি, দোকান-বাজার ও আয়ের উৎসকে রক্ষা করা।
এই দুইয়ের টানাপোড়েনে রাতের ঘুম উড়েছে বরাকরবাসীর। কী ভাবে এই অবস্থা থেকে রেহাই মিলবে, সে কথা ভেবে কূল পাচ্ছেন না এলাকার প্রায় চল্লিশ হাজার বাসিন্দা।
বরাকরের বিভিন্ন বসতি অঞ্চলে ইদানীং বারবার ধস নামছে। গত ১৮ জানুয়ারি সকালে বরাকর স্টেশন রোডের মাঝ বরাবর হঠাৎই প্রায় ১১ ফুট পরিধি ও তিন ফুট গভীরতার গর্ত হয়ে যায়। আশপাশের এলাকায় ফাটল দেখা দেয়। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে মানুষজন রাস্তায় নেমে আসেন। তড়িঘড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেড (বিসিসিএল) এবং কুলটি পুরসভা যৌথ উদ্যোগে বালি ও জলের মিশ্রণ দিয়ে গর্ত ভরাট শুরু করে। কিন্তু সাত দিনের মাথায় ফের ওই একই জায়গায় বিশাল গর্ত ও বড়সড় ফাটল দেখা দেয়। এতে বাসিন্দারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। |
প্রশ্ন হল, বরাকরের বিভিন্ন এলাকায় বারবার ধস নামছে কেন? স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সব অঞ্চলে ধস নামছে সেগুলি বিসিসিএলের ‘লিজ হোল্ড’ এলাকা। সেখানে মাটির নীচ থেকে কয়লার স্তর কেটে তোলার পরে ফাঁকা অংশে বালি ভরাট করা হয়নি। অথবা মাটির স্তর ধরে রাখার জন্য ভূগর্ভে খুঁটি (পিলার) লাগানো হয়নি। বিসিসিএলের চাঁচ ভিক্টোরিয়া এরিয়ার জিএম তারাশিস মণ্ডলের দাবি, “কয়লাখনি রাষ্ট্রীয়করণের আগে বেসরকারি মালিকানায় থাকাকালীন ওই কয়লা কেটে তোলা হয়েছিল।” বিসিসিএল কর্তৃপক্ষ এবং ডিরেক্টর জেনারেল-মাইনস সেফটি (ডিজিএমএস) যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, বরাকর শহরের প্রায় ৩,১২০ বর্গমিটার এলাকা ধসপ্রবণ ও বসবাসের পক্ষে বিপজ্জনক।
বিসিসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯০৪ সালে ওই এলাকায় ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ খনি বানিয়ে ভূগর্ভস্থ কয়লার স্তর কাটা শুরু করে। পরে সংস্থাটি কিনে নেয় থাপার গোষ্ঠী। যথেচ্ছ কয়লা কেটে তুলে নেওয়ার পরে ফাঁকা অংশ ভরাটের ব্যবস্থা হয়নি। ফলে বরাকরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মাটির তলা ফাঁপা হয়ে আছে। ১৯৭২ সালে কয়লাখনি রাষ্ট্রীয়করণ হওয়ার পরে এই খনি এলাকা বিসিসিএলের আওতায় আসে। তারা এই অঞ্চলে কয়লা কাটেনি। কিন্তু আগে বেসরকারি খনিতে ‘অপকর্মে’র মাসুল এখন প্রতি মুহূর্তে গুনছেন বরাকরবাসী। নিরাপত্তার দাবিতে সরবও হয়েছেন।
সমস্যা হল, শ’দুয়েক বছরের পুরনো এই শহরে জনবসতি খুবই ঘন। খুব কম হলেও চল্লিশ হাজার মানুষের বাস। এক শতক আগেই শহরকে কেন্দ্র করে একটি পুরনো বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে অনেকে বসতবাড়ি, দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। রাতারাতি ভূগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন এখন তাঁদের তাড়া করছে। আবার বসতবাড়ি ও আয়ের উৎস ছেড়েও তাঁরা কোথাও যেতে চান না। চিকিৎসক অজয়কুমার পোদ্দার থেকে শুরু করে বরাকর চেম্বার অফ কমার্সের প্রবীণ সদস্য গিরিধারীলাল অগ্রবাল, কেউই তা ভাবতে পারছেন না। তাঁরা বরং চান, প্রশাসন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। কী ভাবছেন খনি কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের কর্তারা?
|
ধস কবে, কোথায় |
• ১৯৩৪ ডিসেরগড় রোডের দক্ষিণে চাষাপাড়ার কিছু অংশে।
• ১৯৫৬ ডাকবাংলোর সামনে। কয়েকটি পুকুর শুকিয়ে যায়।
• ১৯৬৫ বিক্ষিপ্ত ভাবে শহরের একাধিক জায়গায়।
• ১৯৮৮ বাজার এলাকায় ধস। একাধিক দোকানে ফাটল।
• ১৯৯৫ স্টেশন রোডের একটি ব্যঙ্ক দালান হেলে পড়ে। জমিতে ফাটল।
• ১৯৯৬ নিমকানালির কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালে ফাটল, মাটি বসে যায়।
• ২০০২ ডিসেরগড় রোডের বিসিসিএল আবাসনের এলাকায় ধস।
• ২০০২, অগস্ট স্টেশন রোডে বিশাল গর্ত। কয়েকটি বাড়িতে ফাটল।
• ২০০৪, সেপ্টেম্বর নিমকানালিতে একাধিক বাড়িতে ফাটল। মেঝেতে ধস।
• ২০০৭ স্টেশন রোড এলাকায় একাধিক জমিতে ফাটল।
• ২০১৩, ১৮ জানুয়ারি স্টেশন রোডে বিশাল গর্ত। জমিতে ফাটল।
• ২০১৩, ২৫ জানুয়ারি আবারও স্টেশন রোডের প্রায় একই জায়গায় গর্ত। |
|
প্রশাসন এবং খনি কর্তৃপক্ষ আশ্চর্য রকম নীরব।
আমরা খুবই অনিশ্চিত ভাবে দিনযাপন করছি।
সুমনা লায়েক, স্কুল শিক্ষিকা |
সাতপুরুষ ধরে এখানে বাস করছি। ছেড়ে যেতে
পারব না। প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক।
অজয় পোদ্দার, চিকিৎসক |
ধসের আতঙ্কে ব্যবসা মার খাচ্ছে,অর্থনীতি
ভেঙে পড়ছে। প্রশাসনকেই নিরাপত্তা দিতে হবে।
গিরিধারী অগরওয়াল, বরাকর
চেম্বার অফ কমার্সের সদস্য |
প্রতিদিন বিপন্ন বোধ করছি। নিরাপত্তা নিয়ে
প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে আমরা আন্দোলনে নামব।
রামমোহন ভড়, নাগরিক
কমিটির সহ-সভাপতি |
|