ঘরে-বাইরে সমান সক্রিয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
ময়দানে নেমেই তৃণমূলের নিশানায়
ন্দীগ্রামের পরে ২১ জুলাই গুলিচালনা। আবার তৃণমূলের নিশানায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার সিবিআইয়ের কাছে আর্জি জানিয়েছে, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকেও জেরা করা হোক। এই নিয়ে রাজনৈতিক স্তরে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই গুলিচালনার ঘটনা নিয়ে তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সোমবার রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলে এলেন, বুদ্ধবাবুর নির্দেশেই অতি উৎসাহিত হয়ে সে দিন গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের গুলিতে সে দিন যুব কংগ্রেসের ১৩ জন কর্মী মারা যান। মদনবাবু এমনকী বলেন, তিনি হলফ করে এ কথা বলছেন। মিথ্যে প্রমাণিত হলে তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়তেও রাজি।
মদনবাবুর এই সাক্ষ্য নিয়ে এর মধ্যেই একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, রাজ্য সরকার বা তাদের মন্ত্রীরা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে এমন সব জায়গায় কাঠগড়ায় তুলতে চাইছেন, যেখানে গণহত্যার বিষয় রয়েছে। এবং যেখানে আইনি প্যাঁচে পড়তে পারেন বুদ্ধবাবু। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমন করা হচ্ছে? একই সঙ্গে অনেকের জিজ্ঞাসা বুদ্ধবাবুকে নিশানা করার সময় নিয়েও। তাঁদের প্রশ্ন, ঘাড়ের উপরে যখন পঞ্চায়েত ভোট এসে পড়েছে, তখন বুদ্ধবাবুকে আক্রমণ কি জেনেবুঝেই? এ দিন মদনবাবুর সাক্ষ্য নিয়ে আরও প্রশ্ন, যখন মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী, দুই-ই ছিলেন জ্যোতি বসু, বুদ্ধবাবুর হাতে ছিল তথ্য-সংস্কৃতি দফতর, তখন তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে?
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বুদ্ধবাবুকে সামনে রেখেই লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। এবং সরকারের বিরুদ্ধে সেই লড়াইয়ে বুদ্ধবাবুর শিল্পায়নের নীতিকেই হাতিয়ার করা হচ্ছে। বুদ্ধবাবুর জনসভাগুলিতে ভিড়ও হচ্ছে ইদানীং। বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে কার্যত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তখন সরকার-বিরোধী সভা-সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। মাঝেমধ্যে সিপিএমের মুখ হিসেবে উঠে আসেন প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবও। কিন্তু সম্প্রতি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে বুদ্ধবাবু এই সব সভা-সমাবেশে অন্যতম প্রধান বক্তা। গত দেড় বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরেও সরকার যে শিল্পায়ন ও উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি, সে কথা বলে বারবার আক্রমণ করেছেন। অন্যত্র তো বটেই, নন্দীগ্রামের খেজুরিতে তাঁর সভাতেও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রাক-বিধানসভা নির্বাচনে যে ভাবে তাঁর সাক্ষাৎকার নিত বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম, সে ভাবে আজ মঙ্গলবার এবিপি আনন্দ ও আর একটি চ্যানেলে তাঁর সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হবে।
প্রশ্ন উঠেছে, সর্বস্তরে নতুন করে বুদ্ধবাবুর এই গ্রহণযোগ্যতাই কি তৃণমূলকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে? বিভিন্ন জনসভায় বুদ্ধবাবুকে নিশানা করে তোপ দেগেছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। কিন্তু মাঠে বক্তৃতা আর সিবিআইকে জেরা করার অনুরোধ বা বিচার বিভাগীয় তদন্তের সামনে বুদ্ধবাবুকে তোলা এক নয় বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
তাঁদের বক্তব্য, বুদ্ধবাবুকে প্রধান প্রতিপক্ষ বলে মনে করছে তৃণমূল। এ দিন মদনবাবু প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সামনে যা বলেছেন, তা থেকেও এটাই স্পষ্ট হচ্ছে বলে তাঁদের মত। পরিবহণমন্ত্রীর অভিযোগ, ২১ জুলাই গুলি চালানোর ঘটনা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং লালবাজারের পুলিশকর্তাদের পূর্ব পরিকল্পিত।
বুদ্ধবাবুর ভূমিকা নিয়ে তিনি এতটা নিশ্চিত কী ভাবে হলেন, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মদনবাবু। বলেছেন, “আমি মেয়ো রোডে মঞ্চ তৈরির অনুমতি নিতে ২০ জুলাই লালবাজারে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ছাড়াও সেই ঘরে ছিলেন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার দীনেশ বাজপেয়ী, তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (সদর) দেবেন বিশ্বাস এবং তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (অপরাধ দমন) গৌতমমোহন চক্রবর্তী। আমার সঙ্গে পুলিশকর্তাদের বাদানুবাদ হয়। তাঁকে সামনে বসিয়ে লালবাজারের পুলিশ কর্তারা তৎকালীন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করেন।”
পরিবহণ মন্ত্রী বলেন, “বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে পুলিশকর্তাদের কথোপকথন আমি শুনি এবং সেই দিনই বুঝতে পারি, তাঁর নির্দেশেই পুলিশ যুব কংগ্রেসের কর্মীদের উপর হামলার পরিকল্পনা করছে।” মন্ত্রীর দাবি, পুলিশকর্তারা তাঁকে আন্দোলন প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। তাঁকে এ-ও বলা হয়, আন্দোলন প্রত্যাহার করা না হলে পুলিশ যে কী জিনিস, তা বোঝানো হবে। কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে পরিবহণমন্ত্রী আরও জানান, যে সময় পুলিশ গুলি চালায়, তখন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। আগেই নার্সিংহোমে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। প্রাক্তন বিচারপতি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি কাউকে গুলি চালাতে দেখেন। জবাবে মন্ত্রী বলেন, “না।”
কমিশনে সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে পরিবহণমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দীনেশ বাজপেয়ী আমাকে মারতে বাকি রেখেছিলেন। তিনি আমায় গুলি করার হুমকিও দেন।”
মদনবাবুর এই বক্তব্যকে কিন্তু গুরুত্ব দিতে নারাজ বুদ্ধবাবু নিজে। এবিপি আনন্দকে তিনি বলেন, “এ সব ব্যাপারে কেউ নির্দেশ দেয় নাকি? মহাকরণ থেকে কেউ গুলির নির্দেশ দেয় নাকি? ও সব গল্প শুনে লাভ নেই। আজেবাজে লোক মন্ত্রিসভায় বসে আছে। এর উত্তর দিতে গেলে রোজই একটা করে উত্তর দিতে হয়।”
তবে তিনি গুরুত্ব না দিলেও তাঁর দল পরের পর ঘটনায় চক্রান্তই দেখছে। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের মতে, বুদ্ধবাবুকে ফাঁসাতেই এ সব করা হচ্ছে। গৌতম দেব বলেন, “২১ জুলাই নিয়ে জ্যোতি বসু প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ওরা জোর করে মহাকরণ দখল করতে গিয়েছিল। তাই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। ওই দিন যে প্রাণহানি হয়েছে, তার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবুর নাম নিলে তা-ও মানে হতো। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কথা আসে কী করে?” তাঁর বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এ সব বলা হচ্ছে। যদি বুদ্ধবাবুর নামেই অভিযোগ ওঠে তা হলে কমিশন তথ্য পরীক্ষা করে মিলিয়ে নিন। ফাইল তো বুদ্ধবাবু নিয়ে চলে আসেননি।” সীতারাম ইয়েচুরিও প্রশ্ন তুলেছেন, “তখন পুলিশমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। কী ভাবে তথ্যমন্ত্রী পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেবে?” সিবিআইকে দেওয়া রাজ্যের চিঠি প্রসঙ্গে তাঁর মত, “এই চিঠি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে লেখা হয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” কিন্তু কেন? সীতারামের বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখে বুদ্ধদেব দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর সভায় ভিড় হচ্ছে। এ কারণেই বুদ্ধদেবকে নিশানা করেছে তৃণমূল।”
তৃণমূল নেতৃত্ব এই অভিযোগ মানতে নারাজ। মদনবাবু যেমন পরেও বলেছেন, “এখনও সামনে দাঁড়িয়ে বলব, মারতে এসেছিলেন।” মুকুল রায় বলেন, “আমার ধারণা সিবিআই আর মদনের সাক্ষ্য, এই দু’টো ব্যাপার কাকতালীয়। আমরা নির্দিষ্ট ভাবে বুদ্ধবাবুকে নিশানা করিনি।” মুকুলবাবুর ব্যাখ্যা, “১৯৯০ সালে বাদশা আলমরা যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে, তখন বুদ্ধবাবু পার্টির কলকাতা জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ২১ জুলাই যখন গুলি চলে, তখন তিনি দলের তরফে পুলিশের বিষয়টা দেখতেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের একটা তথ্যগত ভিত্তি আছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.