একটা লম্বাটে তার আড়াআড়ি ছুঁড়ে দিয়েছেন ওঁরা। রাস্তার হাইটেনশন লাইন থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে বিদ্যুৎ। নিষ্প্রদীপ বাড়ি ঝলমল করে উঠছে। চলছে রেফ্রিজেরটর থেকে টিভি। এবং নিখরচায়।
চেনা নাম হুকিং। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার চেনা ‘চৌর্য-চিত্র!’
এই বে-নিয়মের অভ্যাসেও ব্যতিক্রম থাকে। হাঁসপুর তেমনই এক ছোট্ট জনপদ। ধুলিয়ানের একটি আবাদি চাষি-গ্রাম।
সেই হাঁসপুরকেই রোলমডেল খাড়া করে ভরসায় বুক বাঁধছে স্থানীয় বিদ্যুৎ বন্টন দফতর। মুর্শিদাবাদের সমশেরগঞ্জ ব্লকের সাড়ে তিনশো ঘরের এই গ্রাম শুধু নিজেদের এক চিলতে বাড়িতেই নয়, গ্রামের সামাজিক অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের প্রয়োজন হলে জেনারেটর ভাড়া করে। হোক না বিপিএল প্রধান গ্রাম, পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের দয়াল মণ্ডলের গলায় স্পষ্ট গর্ব, “খেটে খাই। গায়ে বিদ্যুৎ চোর বদনাম লেপ্টা গেলে সেই জোরটুকুও কমে যাবে যে!” তাই গ্রামের ১২ জন সদস্যকে নিয়ে গনা হয়েছে উন্নয়ন কমিটি। বছর কয়েক আগে গ্রাম-সভা ডেকে তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, গ্রামে কেউ বিদ্যুৎ চুরি করলে তাঁকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। সে টাকা তুলে দেওয়া হবে বিদ্যুৎ দফতরেরই হাতে। তবে সে নিয়ম এ যাবৎ প্রয়োদের প্রয়োজন পড়েনি। দয়ালবাবু জানান, গ্রামের কেউই সে পথে হাঁটেননি।
বিদ্যুৎ দফতরের ডিভিসনাল ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় (রঘুনাথগঞ্জ) হাঁসপুরের উদ্যোগকে বাস্তবিকই ‘উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ মনে করেছেন। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “বিদ্যুৎ দফতর আদর্শ গ্রাম হিসেবে পুরস্কৃত করবে হাঁসপুরকে।” দফতরের রিজিওনাল অফিসার বাসব মৈত্র বলেন, “রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলেছে বলেই তারা জোটবদ্ধ হতে পেরেছে। হাঁসপুরের মানুষকে তাই শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।”
সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য ওই গ্রামের রাধেশ্যাম মণ্ডল জানান, গ্রামে প্রতি বছর কীর্তন হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দুর্গাপুজো। সব কিছুতেই জেনারেটর চালিয়ে আলো জ্বালানো হয়। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ চুরি রুখতে কোনও রাজনীতি নয়। এ ব্যাপারে অন্তত আমরা গ্রামের সম্মান রাখতে সবাই একজোট।” প্রথমে কিছুটা যে অসুবিধা হয়নি এমন নয়। তবে দিনের পর দিন গ্রামে বৈঠক করে সে পর্ব উতরে গিয়েছে হাঁসপুর।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী দুধকুমার মণ্ডল। এই চৌর্যবৃত্তি থেকে মুখ ফেরানোরে কৌশলটা খোলসা করেছেন তিনি, “বছর ছয় আগে যখন গ্রামে কয়েকটা বাড়িতে বিদ্যুৎ আসে, চুরির প্রবণতা তখন যে একেবারেই ছিল না এমন নয়। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই বৈঠক ডেকে ঠিক রা হয়, প্রত্যেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হবে। সকলের বাড়িতেই যদি বিদ্যুৎ থাকে তা হলে চুরির সম্ভাবনা কমবে। এখন তাই এ গ্রামের অধিকাংশের বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ।”
বিদ্যুৎ দফতরও ওই গ্রামে বসিয়েছে দু-দুটো ট্রান্সফরমার। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বলে অন্য কাজ ফেলে তাঁরা ছুটে যান প্রান্তিক ওই গ্রামে। হাঁসপুরকে রোলমডেল করে প্রচারে নামার কথাও ভাবছে বিদ্যুৎ দফতর। |