প্রবন্ধ ২...
‘দশ বছর পরে কেউ মোদীর নাম উল্লেখ করবে না’
শীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়া যায়, গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে এমন বই লেখা সম্ভব কি আদৌ? রামচন্দ্র গুহ-র নতুন বই, ‘প্যাট্রিয়টস অ্যান্ড পার্টিজানস’-এর দুটি ভাগ প্রথমটা ভারতের গণতন্ত্র, রাজনীতি নিয়ে। দ্বিতীয় ভাগে নিছকই কিছু ব্যক্তিগত গদ্য। কোনওটিতে বেঙ্গালুরুর বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা বইয়ের দোকান আর তার মালিকের কথা, কোনও লেখার বিষয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কোনওটি ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’র মতো আদ্যন্ত কাঠখোট্টা একটা পত্রিকার বিষয়ে প্রেমগাথা! এই দ্বিতীয় ভাগের লেখাগুলো বড্ড শীতের দুপুরে পড়ার মতো। উপভোগ্য।
কথাটা শুনে খানিক খুশিই হলেন রামচন্দ্র। বললেন, ‘মোটামুটি জটিল একটা জিনিসকে যদি শীতের দুপুরে পড়ার মতো করে লিখে থাকতে পারি, সেটা তো সাফল্যই। সহজ করে লেখা ব্যাপারটা আসলে সচিন তেন্ডুলকরের স্ট্রেট ড্রাইভের মতো। সচিন যখন মারেন, বেশ সহজ দেখতে। আড়ালে আছে অনেক দিনের অনেক হাড়ভাঙা খাটুনি, প্র্যাকটিস।’
লেখক জীবনের ব্যাখ্যায় তাঁর ক্রিকেট ঢুকে আসবে, প্রত্যাশিতই। এগারো থেকে একুশ, জীবনের দশ বছর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন। নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘মুশকিল ছিল, আমার মতো আরও ছ’কোটি কিশোর একই স্বপ্ন দেখত তখন। প্রথম এগারো জনে ঢোকার মতো প্রতিভা নেই বুঝতে পেরে সেই চেষ্টা ছাড়লাম। ও দিকে অর্থনীতি নিয়ে এম এ পাশ করার পর বুঝলাম, তাতেও হবে না। তেত্রিশ বছর আগের এক জানুয়ারিতে কলকাতায় এসেছিলাম আইআইএম-এ পিএইচ ডি করতে। যে দিন মাদ্রাজ থেকে ট্রেনে চাপলাম, চিপক স্টেডিয়ামে সে দিন ভারত-পাকিস্তান টেস্টের দ্বিতীয় দিন ছিল। দিনের শেষে গাওস্কর ৯২ নট আউট। পর দিন সেঞ্চুরি করলেন, আমি তখন ট্রেনে। তার পর আর কোনও দিন স্টেডিয়ামে বসে গাওস্করের সেঞ্চুরি দেখা হল না।’ খানিক বিষাদ, গলায়?
উত্তরাধিকার। পারিবারিক পরিচয়ই কি দেশের নেতা হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যোগ্যতা? ছবি: পি টি আই
তাঁর বইয়ে অবশ্য বিষাদ সংশয়াতীত। ‘সভ্যতা’ বলতে কিছু বছর আগেও যা বুঝত সবাই, সেটা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার বিষাদ। বহু ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ মানুষরা প্রায় ‘বিপন্ন প্রজাতি’-তে পরিণত হয়েছেন, সেই বিষাদ। বিদ্যাচর্চা ক্রমেই কমে আসছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও, সেই বিষাদ। স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত তিনি? পুরোপুরি মানতে নারাজ রামচন্দ্র গুহ। বললেন, ‘আগের সবই ভাল ছিল, আর এখন সবই খারাপ এমন কথা বলিনি কোথাও। কিন্তু এটা তো সত্যিই, এখন আর গভীর বিদ্যাচর্চার সময় নেই কারও। সবাই চটজলদি কথা বলতে ব্যস্ত। মতামত দিতেই সময় কেটে যায়। আমি ঠিক করেছি, নেহাত অনিবার্য না হলে আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যাব না। বড্ড সময় নষ্ট হয় ওই সব করতে গিয়ে।’
একুশ বছর আগে এমনই এক শীতে যে শহরে তিনি এসেছিলেন জীবনের কাছে আর একটা নতুন সুযোগের প্রার্থনা নিয়ে, সেই কলকাতাও তো হারিয়ে ফেলছে তার বিদ্যাচর্চার সংস্কৃতি। ‘আমি যদি স্মৃতিমেদুর হই, কলকাতা আমার বহু গুণ বেশি স্মৃতিমেদুর। এখনও কলকাতা বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ আর রবিশঙ্করের স্মৃতি নিয়েই বাঁচে। এ দিকে এই শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো যে সব একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটা খেয়ালও করে না। এখন বাঙালিরা কলকাতা ছেড়ে পালায়। আগেও তো কলকাতার বাইরে যেত। কিন্তু ফিরেও আসত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় রচেস্টার থেকে পিএইচ ডি করে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন, রুদ্রাংশ মুখোপাধ্যায় অক্সফোর্ড থেকে ফিরেছিলেন। এখন বাঙালি ছেলেরা আর ফেরে না। কোথায় ফিরবে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা প্রতিষ্ঠানকে সিপিএম হাতে ধরে নষ্ট করে ফেলল। রুদ্রাংশু ছাড়তে বাধ্য হলেন, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় নিউজিল্যান্ড চলে গেলেন। অকল্পনীয় অপচয়।’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কি হয়ে উঠতে পারে কলকাতার একুশ শতকের বিদ্যাচর্চার প্রাণকেন্দ্র? রামচন্দ্র গুহ আশাবাদী। বললেন, ‘এখনও অবধি প্রেসিডেন্সি যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে সম্ভাবনা আছে। বেশি কিছু নয়, জনা পনেরো বিশ্বমানের মেধাবী বাঙালিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর হ্যাঁ, মমতাকে বুঝতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির আখড়া নয়।’ এই আরাবুল-শঙ্কুদেব অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে তাঁর আশাবাদ নিতান্ত অলীক শোনায় যদিও।
প্রশ্ন করি, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগেও বিদ্যাচর্চার জন্য, মেধার ব্যবহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? ফেসবুকের মতো স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট কি তার জায়গা নিতে পারে না? রামচন্দ্র গুহ সংশয়ী। বললেন, ‘ইন্টারনেট এসে অনেকগুলো ভাল ব্যাপার হয়েছে ঠিকই কথা বলার জায়গাটা অনেক গণতান্ত্রিক হয়েছে এখন যে কেউ নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেখানেও মুশকিলটা হল, ভাবার সময় কম। সবাই দ্রুত মতামত দিতে ব্যস্ত। ঠিক এই কারণেই আমি মনে করি, ‘অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়’ জিনিসটাই অলীক। হতেই পারে না। বিদ্যাচর্চার জন্য একটা ফিজিকাল স্পেস দরকার, যেখানে লোকে শুনবে, পড়বে, আলোচনা করবে, বুঝবে। কলকাতায় এখনও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান দ্বীপের মতো টিকে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ যেমন।’
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তো ছাত্রদেরও বোঝায়। গত দশ-পনেরো বছরে তারাও কি মেধার চর্চা ছেড়ে সরে আসেনি শুধু চাকরির পাখির চোখ বেঁধানোর লক্ষ্যে? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও তো আজ আর গ্রামশি বুঝতে চায় না কবে কোন বহুজাতিক সংস্থা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে আসবে, তার অপেক্ষায় থাকে। আর রামচন্দ্র নিজেই তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন ‘ইন্টারনেট হিন্দু’-দের কথা, যারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং ইন্টারনেটের পরিসরে নরেন্দ্র মোদী ব্র্যান্ডের ‘উন্নয়ন’ আর উগ্র হিন্দুত্বের মিশেলের প্রচার চালায় বেঙ্গালুরু বা বস্টন, মুম্বই বা মেলবোর্ন থেকে। এরাই দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা কি আর বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী?
‘ইন্টারনেট হিন্দু’-দের কথা বলেছি বটে, কিন্তু এটাও সত্যি যে তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। নরেন্দ্র মোদী তাদের আরাধ্য উন্নয়নের সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার যে কোনও যোগ নেই, সেটা তারা বুঝতে পারে না। নরেন্দ্র মোদীর আসলে এক ধরনের কর্তৃত্ববাচক ব্যক্তিত্ব আছে, যেটার প্রতি অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা আকৃষ্ট হতে পারে। সেটা চারু মজুমদারেরও ছিল। তাঁকে দেখেই অনেকে নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। স্তালিনেরও ছিল, বাল ঠাকরেরও। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী আসলে সারবত্তাহীন। আমার অনুমান, আর দশ বছর পরে কেউ মোদীর নামও উল্লেখ করবে না।’ রামচন্দ্র গুহ বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন। এবং প্রায় একই শ্বাসে জানিয়ে রাখলেন, কংগ্রেসের ‘রাজবংশ’ও চিরস্থায়ী নয়। আগামী কোনও নির্বাচনে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ধরাশায়ী হলে হয়তো দলের ভিতরেই তৈরি হবে গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ। ‘রাহুল গাঁধী বা নরেন্দ্র মোদী, কেউই ভারতের ভবিষ্যৎ নন।’
কিন্তু তাঁর কথার পিঠেই আর একটা প্রশ্ন উঠে আসে মোদী থাকুন আর না-ই থাকুন, তরুণদের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ব কি ক্রমেই বাড়বে? তাঁর বই জুড়ে যে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জন্য আকুতি রয়েছে, সেই ভারত কি সম্ভব? ‘অবশ্যই সম্ভব’, বললেন রামচন্দ্র। ‘যারা উগ্র, তারা উগ্রতার কারণেই অনেক বেশি প্রকাশ্য। কিন্তু ভারতের ওপর তাদের প্রভাব এখনও প্রান্তিক। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তত অপর ধর্মের প্রতি সহনশীল। তাদের ছাপিয়ে উগ্রদের মতামতই প্রধান হয়ে দাঁড়াবে, সেই সম্ভাবনা কম।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.