প্রবন্ধ ১...
‘রুশদি কে বাপ?’ নিরক্ষর করিম চাচার প্রশ্ন
লমন রুশদির কলকাতা সফর বাতিল নিয়ে চাপান-উতোরে শীতের বাংলা হঠাৎ উত্তপ্ত। সমস্যা হল, এই তাপ তো ঠান্ডা হয়ে যাবে নতুন ‘ইস্যু’তে ঢেকে যাবে রুশদি-পর্ব; কিন্তু ‘মুসলমানরা অসহিষ্ণু মৌলবাদী’, এই চলে আসা ধারণাটাতে আরও খানিক তেল-মশলা যোগ হল। যাঁরা মুসলমানদের মৌলবাদী কল্পনা করতে ভালবাসেন, তাঁরা যে আরও একটা হাতে-গরম পাক্কা প্রমাণ পেয়ে গেলেন, সেটা অতঃপর বার বার উল্লেখ করা হবে। কেননা, যে কারণেই সলমন সাহেবের সফর বাতিল হয়ে থাক না কেন, কয়েক জন মুসলমান যে এয়ারপোর্টে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিল এতে তো কোনও ভুল নেই! কিন্তু, এই ক’জন মুসলমানই কি ‘মুসলমান’? তাঁরাই কি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রতিনিধি?
এ রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা দু’কোটির বেশি; তাঁদের প্রধান অংশটা থাকেন গ্রামে। সাম্প্রতিক নানা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁদের শতকরা আশি ভাগেরও বেশি দিন-আনি-দিন-খাই; আর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারে সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরক্ষরতা! যাঁরা সাক্ষর, তাঁদেরও একটা সামান্য অংশই স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন। প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে মুসলমানদের শতাংশ ২৫, উচ্চ মাধ্যমিকে সেটা নেমে দাঁড়ায় ৮-এ, আর স্নাতক স্তরে ৪-এ! শিক্ষক, অধ্যাপক, কেরানি, ডাক্তার, মোক্তার এবং সর্বক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের মধ্যে মুসলমান খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। এমন নয় যে, মুসলমানরা লেখাপড়া শিখতে চান না। বরং উল্টোটা। মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিমবহুল জেলার স্কুলগুলোতে গিয়ে দেখুন, ছেলে-মেয়ে উপচে পড়ছে। তাঁদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক স্কুল-শিক্ষক ও অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাবটাই যে তাঁদের শিক্ষার প্রধান সমস্যা, এটা তো সরকারি তথ্য থেকেই দেখা যায়; যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় প্রত্যক্ষ সমীক্ষামূলক গবেষণা থেকে। (‘প্রতীচী শিক্ষা প্রতিবেদন-২’-সহ নানান গবেষণা থেকে এটা দেখা গেছে)।
একটা বিদঘুটে মজা আছে। সরকারি ভাবে শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার না ঘটানো নিয়ে আত্মসমালোচনা বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ই না, উল্টে কাল্পনিক অভিযোগ তোলা হয়, ‘মুসলমানরা ইস্কুলে না পাঠিয়ে খালি মাদ্রাসায় পাঠায়!’ একই কথা স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশু-পুষ্টি সংক্রান্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে। মুসলমানবহুল এলাকাগুলোতে এই সব পরিষেবার অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু, সে ব্যবস্থাগুলো না করে সারাক্ষণ গাল পাড়া চলছে, ‘মুসলমানরা আধুনিক চিকিৎসা নিতে চায় না।’
শিক্ষাগত সুযোগ-বঞ্চনা ডানা মেলতে মেলতে, স্বাস্থ্য কর্মনিয়োজন থেকে শুরু করে মুসলমান আকাশটাকে এমন ভাবে ঢেকে দেয়, যে তাঁদের ঘরগুলোতে আঁধার কাটেই না। এই যে জনসমুদয়, এঁরা কত জন রুশদির নাম জানেন? রুশদি কী লিখেছেন, না লিখেছেন কত জন তার খবর রাখতে সমর্থ? আমার গাঁয়ের করিম চাচাকে যখন বললাম রুশদি বিতর্কের কথা, চাচা নিজের পেটটা দেখিয়ে বললেন, ‘বাপজান! এই পেটটা ভরানোর চিন্তাতেই ফুরসত নেই তোর রুশদি-ভুশদির খবর রাখব কখন? তা সেই রুশদি কে বাপ? আর, আমি তো নিরক্ষর। খবর রাখবই বা কী করে?’ মুসলমানদের মধ্যে বেশির ভাগেরই তো খবর রাখার সক্ষমতাটুকুও গড়ে ওঠেনি শিক্ষাগত সুযোগের অভাবে এবং সেই সঙ্গে সমাজের উঁচু তলার প্রতিনিধিত্বের অভাবে।
মুসলমানদের এই যে দারিদ্র ও অক্ষমতা, সেগুলো দূর করার জন্য তো সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ করেনি; বামফ্রন্টও করেনি, বর্তমান সরকারও না। উল্টে সরকারি নীতিটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকারান্তরে এটা প্রমাণ করা যে, ‘মুসলমানরা ধর্ম ছাড়া কিছু বোঝে না’। সেই জন্য সস্তায় মুখরোচক নানান ব্যবস্থা, হজ-এর জন্য ভর্তুকি, মুয়াজ্জিমদের মাইনে এবং নামমাত্র কয়েক জন মুসলমানের তথাকথিত ‘দাবি’ মেনে নিয়ে রুশদিকে আসতে না দেওয়ার মতো কিছু ব্যবস্থা। মুষ্টিমেয় কিছু লোককে সব মুসলমানের প্রতিনিধি বানিয়ে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যেটা করা হয়, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বঞ্চনা বাড়ে বই কমে না।
উল্টো দিকে, সমস্ত মানুষের জন্যই সরকারের যে সুবিধাগুলো সমান ভাবে প্রসার করা উচিত, সেটা ভাল ভাবে করা হলেই মুসলমানদের বহু সমস্যার সমাধান ঘটে। এ ভাবে শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব বাড়তে পারে এবং তাঁদের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল আলোচনা করতে পারেন নিজেদের এবং অন্যদের সঙ্গে। এবং রুশদি কী লিখলেন বা না-লিখলেন, সেই ধরনের ঝালগুলো অন্যের মুখে না খেয়ে নিজেরাই পরখ করে দেখতে পারেন। কিন্তু বাম সরকারের আমলে তাঁদের শোনানো হয়েছে, ‘আমাদের রাজত্বে দাঙ্গা হয়নি, তোমরা নিরাপদ।’ ক্ষুধা, অশিক্ষা, অপুষ্টির নীরব ‘দাঙ্গা’টা বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ কিন্তু হয়নি। পরিবর্তনের সরকার আবার অধিক মুসলমানপ্রীতি দেখাতে গিয়ে এমন কিছু ধর্মীয় ভাবাবেগকেই তুলে ধরছে, লোকেদের জীবনমানের সঙ্গে যার কোনও যোগ নেই। সরকারি ভাবেই একটা ‘মুসলমান-করণ’ ঘটে যাচ্ছে।
ঘুরে বেড়ানোই আমার কাজ। কোচবিহার থেকে পুরুলিয়া, নানান জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের যে চেষ্টা গ্রামেগঞ্জে নজরে পড়ে, সেটা হল নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তোলা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া ইত্যাদি। সাধারণ ঘরের মুসলমানদের কথাতেও এটাই ক্রমাগত বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে ধর্মাচরণের যে কোনও বিরোধ নেই, সেটা তাঁরা জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন সেটাই একমাত্র ভরসার কথা।

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.